‘ওরা সবাই বেঁচে আছে রবিন। তুমি তো বললে যিশু আমাদের বিজয় চাইছেন, আমি বলছি, ঈশ্বর আমাদের কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছেন। আইয়ুবী বেঁচে আছে, কারণ তীর তার গায়ে লাগেনি। তীর বিঁধেছে তার দু’পায়ের ফাঁকে, মাটিতে।’
‘কোন মেয়ে তীর ছুড়েছিল?’ রবিনের কণ্ঠে ঝাঁঝ। ‘ক্রিস্টোফার কোথায় ছিল?’
‘ও-ই তীর ছুড়েছে। কিন্তু…’
‘ক্রিস্টোফারের তীর লাগেনি!’ রবিনের কণ্ঠে বিস্ময়। ‘লক্ষ্য ভেদের জন্য সম্রাট অগাষ্টাস নিজের তরবারি দিয়ে তাকে পুরস্কৃত করছেন। এখানে এসে ছ’ফুট দীর্ঘ আর তিন ফিট চওড়া সালাহউদ্দীনের গায়ে ও তীর লাগাতে পারল না। তীর ছোড়ার সময় ভয়ে হারামিটার হাত কাঁপছিল নাকি?’
‘দুরত্ব ছিল বেশী। ক্রিস্টোফার বলেছে, তীর ছোঁড়ার সময় বাম চোখে একটা মাছি এসে বসায় লক্ষ্য স্থির থাকেনি।’
‘তারপর কি হল?’
‘যা হবার তাই। সালাহ্উদ্দীনের সাথে ছিল তিনজন সেনাপতি এবং চারজন দেহরক্ষী। ওরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ভাগ্য ভাল, পাহাড়ী এলাকা বলে বেঁচে গেছি। তীর বালির নীচে লুকিয়ে ফেলেছিলাম। সেপাইরা এলে ক্রিস্টোফার বলল, আমরা পাঁচজন মরক্কোর ব্যবসায়ী। এ মেয়েদেকে সাগর থেকে উদ্ধার করেছি। আমাদের মালপত্র তল্লাশী নেয়া হল। ব্যবসায়িক সামানাদি ছাড়া কিছুই পাওয়া গেল না। আমাদেরকে আইয়ুবীর সামনে নেয়া হল। বোঝালাম আমরা সিসিলি ভাষা ছাড়া কিছুই জানি না। দোভাষীর কাজ করল ক্রিস্টোফার।’
মুবি পুরো ঘটনা শোনাল রবিনকে। ব্যবসায়ীরূপী পাঁচ ব্যক্তি এবং এই সাতটি মেয়ে ছিল খৃস্টানদের বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গুপ্তচর। গোয়েন্দা কাজ ছাড়াও মেয়েদের দায়িত্ব ছিল মুসলিম সেনাপতি, কমাণ্ডার এবং দায়িত্বপূর্ণ লোকদের ফাঁসানো। রবিন এ গ্রুপের কমাণ্ডার।
‘তুমি আইয়ুবীকে রূপের জালে জড়াতে পারো না মুবি?’
‘কেবল তো প্রথম রাত। আমাদেরকে আরো অপেক্ষা করতে হবে। বুঝতে হবে কোন পথে এগোনো যায়। আমাদের ব্যাপারে সে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে তা যদি তার মনের কথা হয়, তবে বুঝতে হবে, সে মানুষ নয়, পাথর। সে জানে আমরা অসহায়। চাইলেই সে আমাদের পেতে পারে, অথচ একজনকেও সে তার তাঁবুতে ডাকেনি।’
‘তাকে হত্যা করাও সহজ নয়। সব সময় সে থাকে সেনাপতি আর রক্ষী পরিবেষ্টিত হয়ে। মাথার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে সশস্ত্র প্রহরী।’
‘শুনেছি ওই পাজিটা নাকি মদও স্পর্শ করে না।’
‘তোমাদের সঙ্গী পাঁচজন এখন কোথায়?’
‘ওরা কাছেই আছে। ওদের নিয়ে তুমি ভোবোনা, এরা এখানেই থাকবে।’
‘মুবি, পরাজয় আমাকে পাগল করে দিয়েছে। এর জন্য আমিই দায়ী। সকল সৈনিকই ক্রুশ হাতে নিয়ে শপথ করে। কিন্তু আমার আর তাদের শপথে আসমান জমিন ফারাক। পেছন থেকে আক্রমণ করে আমরা অর্ধেক বিজয় ছিনিয়ে আনি। কিন্তু আমরা কেউ আমাদের দায়িত্ব পালন করিনি।’
গলায় ঝুলানো ক্রুশ হাতে নিয়ে রবিন বলল, ‘এ ক্রুশ আমার কাছে জবাব চাইছে। একে আমি বুক থেকে সরাতে পারিনা।’
নিজের ক্রুশ ছেড়ে রবিন মুবির জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিল। ওর বুকের সাথে সেটে থাকা ক্রুশ বের করে বলল, ‘তুমি তোমার পিতা মাতাকে ধোঁকা দিতে পার, কিন্তু এ পবিত্র ক্রুশের সাথে প্রতারণা করতে পার না। ঈশ্বর তোমায় ক্লিওপেট্রার চেয়ে বেশী রূপ দিয়েছেন। তোমার দেহের মাদকতা, রূপের জৌলুস পাহাড় কেটে তোমার জন্য পথ খুলে দেবে। আমাদের এ অযাচিত সাক্ষাতে মনে হচ্ছে, আমরা পরাজয়ের গ্লানি থেকে বাঁচতে পারবো। আমরা ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারলে আমরাই বিজয়ী হব। রোম উপসাগরের ওপারে আমাদের ফৌজ জমা হচ্ছে। যারা মরেছে, মরেছে। বেঁচে আছে যারা তাদের বিশ্বাস, প্রতারণার শিকার হয়ে আমরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি ঠিক, কিন্তু এ আমাদের চুড়ান্ত কোন পরাজয় নয়। নিজের তাঁবুতে ফিরে যাও। অন্য মেয়েদের বলো, তাঁবুতে পড়ে ঘুমানো এদের কাজ নয়। বার বার আইয়ুবীর সাথে দেখা করবে। সাক্ষাৎ করবে সেনাপতিদের সাথে। প্রেমের অভিনয় করবে। লোভ দেখাবে দেহের। যৌবনের আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেবে ওদের ঈমানের আগুন। আর একবার যদি এতে সফল হতে পার সবকিছু আমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে।’
‘সবার আগে আসল ঘটনা জানতে হবে, জানতে হবে কেন এমনটি ঘটল। সুদানীরা কি আমাদের সাথে প্রতারণা করেছে?’
‘নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারছি না। যুদ্ধের আগে আমাদের গোয়েন্দাদের রিপোর্ট ছিল সালাহউদ্দীন আইয়ুবী মিসরের গভর্ণর এবং ফৌজের সর্বাধিনায়ক হয়ে এসেছেন। নতুন ফৌজ গঠন করছেন মিসরীদের দিয়ে। নাজির পঞ্চাশ হাজার সৈন্য তার সাথে যোগ দেয়নি। নাজি আমাদের কাছে সাহায্য চেয়ে পাঠায়। নাজির সে চিঠি আমি নিজে দেখেছি। তার লেখা আমি চিনি, ওটা যে তারই চিঠি ছিল এ ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু কি করে এমনটি ঘটল কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। এটা যদি প্রতারণা হয় তবে বলল, ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য প্রতারণা করা হয়েছে আমাদের সাথে।’
‘রবিন, অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ে লাভ নেই। সবার আগে আমাদের জানতে হবে এসব কি করে হল? কে করল?’
‘মুবি, মনে করোনা এ রহস্য না জেনেই আমি এখান থেকে যাব। সম্রাট অগাষ্টাস গর্ব করে বলেছিলেন, মুসলমানদের ভেতরের খবর সংগ্রহ করে ওদের নিশ্চিহ্ন করে দেব। ভেবে দেখ মুবি, সম্রাটের হৃদয়ে এখন কি ঝড় বইছে। আমরা যা করেছি তাতে মৃত্যুদণ্ডই আমাদের প্রাপ্য। আমাদের কারণেই ক্রুশের এ বিপর্যয়। আমি ক্রুশের অভিশাপকে ভয় পাচ্ছি।’