খৃস্টানদের সম্মিলিত নৌশক্তি বিধ্বস্ত হয়েছে সাতদিন আগে। উপকূল ছেড়ে জাননি সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। এখনো সাগর বক্ষে ঢেউয়ের দোলায় দুলছিল দু’একটি পালছেড়া জাহাজ, মাল্লাহীন নৌকা। জ্বলন্ত জাহাজ থেকে সাগরে ঝাঁপ দিয়ে বাঁচতে চেয়েছে অনেক সৈন্য। ঢেউয়ের তালে ভেসে বেড়ানো জাহাজ এবং নৌকা তল্লাশীর জন্য সালাহউদ্দীন আইয়ুবী লোক লাগিয়ে দিলেন। অক্ষত নৌকা এবং জাহাজ তীরে নিয়ে আসছিল ওরা। অকেজো জাহাজ থেকে মালপত্র বের করা হচ্ছিল। বেশীর ভাগই অস্ত্র এবং খাদ্য সামগ্রী।
ঢেউয়ের আঘাতে বেলাভূমিতে আছড়ে পড়ছিল অর্ধদগ্ধ অথবা মাছে খাওয়া লাশ। জাহাজের ভাঙা কাঠ আঁকড়ে সাগরে ভাসছিল কিছু জীবন্ত মানুষ। ঢেউ ওদের তীরে ঠেলে দিচ্ছিল। সমগ্র বেলাভূমিতে পাহারা দিচ্ছিল মুসলিম ফৌজ। আহত খৃস্টান সৈন্যদের কুড়িয়ে এনে চিকিৎসা করা হচ্ছিল তাদের। ঘোড়ায় চড়ে উপকূল ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন সুলতান আইয়ুবী।
ঘুরতে ঘুরতে ছাউনি থেকে দু’মাইল দুরে চলে এলেন তিনি। সামনে পার্বত্য এলাকা। পাহাড়ের একদিকে সাগর, অন্যদিকে খেজুর, নানা রকম গাছগাছালি এবং লতাগুল্ম ঘেরা প্রান্তর। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর সাথে তিনজন সেনাপতি ও চারজন দেহরক্ষী।
ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন তিনি। ঘোড়ার বাগ রক্ষীদের হাতে দিয়ে হাঁটতে লাগলেন। সেনাপতি তিনজনও ঘোড়া থেকে নেমে তার সঙ্গ নিল। এদেরই একজন বন্ধু বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ। যুদ্ধের একিদন আগে মাত্র তিনি এখানে এসেছেন।
শীত মওশুমের শান্ত সাগর। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে এলেন তিনি। রক্ষীদের দৃষ্টির আড়ালে। সামনে পেছনে ছোট ছোট টিলা আর বালিয়াড়ি। বাঁয়ে পাহাড়। ডানে বেলাভূমির দিগন্ত বিস্তৃত বালুকারাশি। চার পাঁচ হাত উঁচু এক বালিয়াড়িতে উঠে দাঁড়ালেন আইয়ুবী। দৃষ্টি ছুঁড়লেন রোম উপসাগরের নীল জলরাশিতে। মনে হল সাগরের সব নীল জমা হয়েছে তার চোখে। বিজয়ের আনন্দে চেহারা উদ্ভাসিত। নাক কুঞ্চিত করে বললেন, ‘ভীষণ দুর্গন্ধ।’
সৈকতে আছড়ে পড়ল সব ক’টি চোখ। আকাশে ওড়াওড়ি করছে কতগুলো শকুন। ধীরে ধীরে নিচে নেমে গেল ওরা। সুলতান বললনে, ‘ওখানে মড়া আছে।’
ঢিবি থেকে নেমে চারজনই সেদিকে এগিয়ে গেলেন। পনের বিশগজ দূরে এক ঝাঁক শকুন লাশের মাংস খাচ্ছে। একটা শকুন এক মড়ার মাথার খুলি নিয়ে আকাশে উড়ল। কিন্তু পাঞ্চা থেকে ছুটে গেল মুণ্ডটা। পড়ল এসে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর সামনে। তিনি মাথাটার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে রইলেন। মাথাটার খোলা চোখ আইয়ুবীর দিকে তাকিয়ে আছে যেন।
সালারদের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তিনি বললেন, ‘এ মাথাটা মুসলমানদের মাথা থেকে অনেক ভাল। এ মস্তিষ্কের জোরেই ওরা নারী আর মদে মাতাল করে দিচ্ছে সমগ্র মুসলিম খেলাফত।’
‘ওরা ইঁদুরের মত মুসলিম বিশ্বকে কুরে কুরে খাচ্ছে সুলতান।’ বললেন এক সেনাপতি।
আরেকজন বললেন, ‘আমাদের সম্রাটগণ ওদের নিয়মিত কর দিয়ে যাচ্ছে।’
শাদ্দাদ বললেন, ‘ফিলিস্তিন ওদের দখলে সুলতান। আমরা কি কোনদিন তা পুনরুদ্ধার করতে পারব না?’
‘আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়োনা শাদ্দাদ।’
‘আল্লাহর রহমত থেকে না হলেও আমরা আমাদের ভাইদের দিক থেকে নিরাশ হয়ে পড়েছি।’
‘তুমি ঠিকই বলেছ। বাইরের আক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব। একবারও কি ভেবেছ, কি করে খৃস্টানদের এতবড় নৌশক্তি আমরা নিঃশেষ করে দিলাম? খোলা ময়দানে নয়, শুধু কমাণ্ডো হামলার মাধ্যমে। ওদের ফৌজ সমগ্র মিসর ধ্বংস করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু বন্ধুরা, ভেতরের আক্রমণ এত সহজে ঠেকানো সম্ভব হত না। ভাই আক্রমণ করলে ভাববে, সত্যিই কি ভাই আক্রমণ করেছে! যখন তার বিরুদ্ধে তরবারী তুলবে, দুশমন এ সুযোগ নেবে, নিঃশেষ করবে দু’জনকেই।’
পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এগিয়ে চললেন সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। কিছু দূর এগিয়ে কি দেখে থমকে দাঁড়ালেন। নুয়ে মাটি থেকে জিনিসটা তুলে দেখালেন সবাইকে।
একটা ক্রুশ, তালায় বাঁধা।
ছড়িয়ে থাকা লাশগুলোর দিকে তাকালেন আবার। আগেই সেই খুলিটা নিয়ে ঝগড়া করছে তিনটে শকুন।
দ্রুত মাথাটার কাছে গেলেন তিনি। ক্রুশটা সেই মাথার ওপর রেখে ফিরে এলেন সংগীদের কাছে। বললেন, ‘আমি এক বন্দী খৃস্টান অফিসারের সাথে কথা বলেছি। ও বলেছে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হবার সময় সকলকেই ক্রুশের ওপর হাত রেখে শপথ করতে হয়। জীবন বাজি রেখে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শপথ নেয়ার পর সব সৈনিকের গলায় একটি করে ক্রুশ ঝুলিয়ে দেয়া হয়। জানিনা কুড়িয়ে পাওয়া এ ক্রুশটি কার? ক্রুশের জন্যই এরা জীবন দিয়েছে। খুলিটার ওপর ক্রুশটা রাখলাম, একজন সৈনিকের শপথের অমর্যাদা যেন না হয়।’
‘সুলতান’, শাদ্দান বললেন, ‘জেরুজালেমে খৃস্টানরা মুসলমানদের কি মর্যাদা দিচ্ছে আপনি জানেন? ওখান থেকে স্ত্রী পরিজন নিয়ে পালিে যাচ্ছে মুসলমানরা। লুন্ঠিত হচ্ছে আমাদের মেয়েদের ইজ্জত। এখনো আমাদের বন্দীদের ওরা ছেড়ে দেয়নি। মুসলমানরা ওখানে পশুর মত জীবন যাপন করছে। আমরা কি এর প্রতিশোধ নেব না?’
‘প্রতিশোধ নয় শাদ্দাদ, আমরা ফিলিস্তিন পুনরুদ্ধার করতে চাই। কিন্তু আমাদের শাসকরাই এ পথের বড় বাঁধা। ওরা ক্রুশ স্পর্শ করে মুসলিম বিশ্বকে নিঃশেষ করার শপথ নিয়েছে, আমিও আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে বুকে হাত দিয়ে শপথ করে বলছি, অবশ্যই ফিলিস্তিন পুনরুদ্ধার করব। কিন্তু বন্ধুরা, আমাদের ভবিষ্যত ইতিহাস আঁধারে ছেয়ে যাচ্ছে।