আলীর প্রশ্নের জবাবে ওরা নিজেদের ব্যবসায়ী পরিচয় দিল। তল্লাশীর পর পাওয়া গেল নাজির লেখা চিঠি। আলী খানিক বিশ্রাম করে বন্দীদের নিয়ে রাজধানীর পথ ধরলেন।
চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুণছিলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। দিন শেষে রাত এল। গভীর হয়ে এল রাতও। অনেক রাতে বিছানায় পিঠ লাগালেন আইয়ুবী। ভোর রাতে দরজায় মৃদু করাঘাতের শব্দে জেগে উঠলেন তিনি। তড়িঘড়ি দরজা খুলে দেখলেন বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আলী। পেছনে আটজন সওয়ার এবং দু’জন বন্দী। আইয়ুবী সকলকে ভেতরে ডেকে নিলেন। নাজির চিঠি এগিয়ে দিল আলী।
চিঠি খুললেন আইয়ুবী। কয়েক লাইন পড়তেই ক্রোধে বিবর্ণ হয়ে গেল তার চেহারা। পলকে আনন্দ ঝলকে উঠল চোখে মুখে। নাজি তার দীর্ঘ চিঠিতে খ্রিষ্টান সম্রাট ফ্রাংককে আক্রমণের জন্য দিনক্ষণ ঠিক করে দিয়েছে। লিখেছে, রোম উপসাগর উপকূলে নৌবহর থেকে খৃস্টান সৈন্যরা নেমেই মিসর আক্রমণ করবে। এদিকে বিদ্রোহ করবে পঞ্চাশ হাজার সুদানী ফৌজ। সালাহউদ্দীনের নতুন সৈন্যরা এক সঙ্গে দুই ফৌজ মোকাবিলা করতে পারবে না। এর বিনিময়ে নাজি সমগ্র মিসর অথবা মিসরের একাংশ ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব করেছে।
‘জেলে পাঠিয়ে দেয়া হল বন্দী দু’জনকে। নাজি এবং তার সঙ্গীদের নিজস্ব বাসগৃহে নজরবন্দী করা হল। নাজির হারেমের মেয়েদেরকে ছেড়ে দেয়া হল। বাজেয়াপ্ত করা হল নাজির ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এ সব কিছুই করা হল অত্যন্ত গোপনে ও সতর্কতার সাথে। নাজি লিখিত চিঠি দু’জন দূত মারফত শুধু আক্রমণের তারিখ পরিবর্তন করে ফ্রাঙ্কোর কাছে পাঠিয়ে দিলেন আইয়ুবী। দুই সেনাবাহিনীর একত্রীকরণ সাময়িকভাবে স্থগিত করে দেয়া হল।
দূত ফিরে এল আট দিন পর। নাজিকে জবাব লিখেছেন ফ্রাঙ্ক। সালাহউদ্দীন যেন আক্রমণ প্রতিহত করতে না পরে এজন্য আক্রমণের দুদিন আগেই বিদ্রোহ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এ সংবাদ গোপন রাখার স্বার্থে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর অনুমতি নিয়ে আলী দু’জন দূতকে সসম্মানে গৃহবন্দী করে রাখলেন।
রোম উপসাগরের পাড়ে নির্দিষ্ট স্থানের আশপাশে আইয়ুবী নিজের সৈন্যদের লুকিয়ে রাখলেন। আক্রমণের এখনো কয়েকদিন বাকী। পত্রের নির্দেশ মত খৃস্টান হামলার পূর্বেই নির্দিষ্ট দিনে সুদানী ফৌজ বিদ্রোহ ঘোষণা করল। শক্তি প্রয়োগ না করে ডিপ্লোমেসী এবং সুন্দর ব্যবহার দিয়ে আইয়ুবী এ বিদ্রোহ দমন করলেন। সেনাপতির অনুপস্থিতি ছিল ওদের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ।
সুদানী ফৌজ বিদ্রোহ করার দু’দিন পর নির্দিষ্ট তারিখে দেখা গেল খৃস্টানদের নৌবহর এগিয়ে আসছে। এর মধ্যে ফ্রান্স, গ্রীস, রোম এবং সিসিলির যুদ্ধ জাহাজ ছিল ১৫০টি। এসব জাহাজের মধ্যে ১২টি ছিল খুবই বিশাল। এসব জাহাজ মিসরে অবতরণকারী সৈন্য বহন করছিল।
খৃস্টানদের এ বাহিনীতে কেবল কমাণ্ডারই ছিল এক লাখ। রসদ এবং অস্ত্র বোঝাই নৌকার সংখ্যা ছিল অগণিত। জাহাজগুলি এগিয়ে আসছিল দুই সারিতে। সালাহউদ্দীন আইয়ুবী নিজে মিসর বাহিনীর নেতৃত্ব নিয়ে এগিয়ে গেলেন এর মোকাবেলা করতে।
জাহাজ উপকূলের কাছে আসার অপেক্ষায় রইলেন তিনি। সবচেয়ে বড় জাহাজটি কিনারে এল। হঠাৎ জাহাজ লক্ষ্য করে অগ্নি গোলা নিক্ষিপ্ত হতে লাগল। কামানের গোলায় আগুন ধরে গেল পালে। আড়াল থেকে বেরিয়ে এল মুসলমানদের যুদ্ধ জাহাজ। ওদের জাহাজগুলো ছিল কাঠের তৈরী। দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল সাগর বক্ষে। মনে হচ্ছিল আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে নিচ্ছিল সমগ্র রোম উপসাগর।
খৃস্টান জাহাজগুলো পালাতে গিয়ে পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে আগুন আরো ছড়িয়ে পরল। সৈন্যদের অনেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল সাগরে। যারা সাঁতরে তীরে উঠার চেষ্টা করছিল আইয়ুবীর তীরন্দাজদের নিশানা হল ওরা।
ওদিকে নুরুদ্দীন জংগী ফ্রাঙ্ক সম্রাটের রাজধানী আক্রমণ করলেন। মিসরের দিকে এগিয়ে আসা স্থলবাহিনী এ সংবাদ পেয়ে স্বদেশের দিকে ফিরে চাইল। কিন্তু সালাহউদ্দীন আউয়ুবীর সাড়াশী আক্রমণের ফলে রোম উপসাগরে সলীল সমাধি হল ওদের। এ যুদ্ধে সম্মিলিত খৃস্টান নৌশক্তি নিঃশেষ হয়ে গেল। আগুনে পুড়ে এবং সাগরে ডুবে নিহত হল অসংখ্য নৌ সেনা।
কমাণ্ডার এসমার্ক আত্মসমর্পণ করে সন্ধির প্রস্তাব করল। প্রচুর অর্থের বিনিময়ে তাকে মুক্তি দেয়া হল। গ্রীস এবং সিসিলির কিছু যুদ্ধ জাহাজ বেঁচে গিয়েছিল। আইয়ুবী তাদের ফিরে যাবার অনুমতি দিলেন। কিন্তু হঠাৎ সাগরে ঝড়ের কবলে পড়ে সব কটি জাহাজ নিশ্চিহ্ণ হয়ে গেল। ১১৬৯ সনের ১৯শে ডিসেম্বর কর প্রদানের শর্তে খৃস্টানরা সন্ধি চুক্তিতে স্বাক্ষর করল। বলতে গেলে এ বিজয়ের মূল কৃতিত্ব ছিল গোয়েন্দা সংস্থার।
এ ছিল দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী ক্রুসেডের প্রথম লড়াই। ইতিহাসের পাতায় খৃষ্টান ও মুসলমানদের মধ্যে সংঘটিত অসংখ্য লোমহর্ষক ক্রুসেডের যে কাহিনী ছড়িয়ে আছে তা আরো চমকপ্রদ, আরো ঘটনাবহুল।
ঐতিহাসিকরা বলেন, এতো কেবল মাত্র শুরু। সালাহউদ্দীন আইয়ুবী ক্রমেই প্রবেশ করলেন জীবনের বিপজ্জনক সব অধ্যায়ে। যে সব অধ্যায় অতিক্রম করে তিনি হয়েছিলেন গাজী সালাহউদ্দীন। তার সে বিপদজনক জীবনের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, সংঘর্ষ এবং রহস্য ও রোমাঞ্চের ভয়াবহ সব জটিল ও কুটিল অধ্যায়।