‘কেন, কি হয়েছে?’
‘রক্ষীরা বলছে, সুদানী বাহিনীর জন্য মদ বৈধ হলে আমরা কি অপরাধ করেছি? আমার অনুযোগকে অপরাধ মনে করলে যে কোন শাস্তি মাথাপেতে গ্রহণ করব। গভর্ণকে আমরা একজন সৎ চরিত্রবান এবং খোদাভীরু লোক বলে জানি, হাসিমুখে জীবন বিলিয়ে দিতে পারি তার সামান্য ইশারায়।’
‘কিন্তু গত রাতে তার তাঁবুতে এক নর্তকী প্রবেশ করেছিল, এইতো!’ কমাণ্ডারের মুখের কথা টেনে নিলেন গোয়েন্দা প্রধান। ‘না, তুমি কোন অপরাধ করনি। রাজা করুক আর প্রজা করুক, পাপ সে পাপই। আমি তোমাকে আশ্বাস দিচ্ছি, গভর্ণরের সাথে গোপন সাক্ষাতের মধ্যে পাপের কোন সম্পর্ক ছিল না। তাদের মধ্যে কি কথা হয়েছে এ মুহূর্তে বলা যাবে না। কয়েকটা দিন যাক, সব নিজেরাই বুঝতে পারবে।’
কমাণ্ডারের কাঁধে হাত রেখে তিনি আবার বললেন, ‘আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোন আমের বিন সালেহ, তুমি অভিজ্ঞ সৈনিক। ভাল করেই জান ফৌজ এবং ফৌজি কর্মকর্তাদের এমন কিছু গোপন ব্যাপার থাকে যার গোপনীয়তা রক্ষা করা সকলের কর্তব্য। নর্তকী আইয়ুবীর তাঁবুতে গিয়েছিল তাও এক গোপন ব্যাপার। কাউকে সন্দেহের মধ্যে রেখো না, কারো সামনে ভুলেও প্রকাশ করোনা সে রাতে কি ঘটেছিল।’
আলীর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কমাণ্ডার অবহিত ছিল। সে নিশ্চিত হয়ে গেল। সন্দেহের অবসান ঘটল সেপাইদেরও।
দুপুরের খানা খাচ্ছিলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী, তাকে নাজির আগমনের সংবাদ দেয়া হর। খাওয়া শেষে তিনি তাকে ডেকে পাঠালেন। নাজির চেহারায় শংকা এবং ক্রোধের অভিব্যক্তি। কম্পিত কণ্ঠে সে বলল, ‘মহামান্য আমীর! পঞ্চাশ হাজার সুদানী ফৌজকে সদ্য প্রস্তুতকৃত ফৌজের সাথে একীভূত করার নির্দেশ কি আপনি দিয়েছেন?’
‘হ্যাঁ, অনেক চিন্তা ভাবনার পর এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আরো সিদ্ধান্ত নিয়েছি, মিসরের সেনাবাহিনীতে শতকরা ১০ জন থাকবে সুদানী সৈন্য। আপনাকে হেডকোয়ার্টারে বদলী করা হয়েছে, এখন থেকে আপনি আর সুদানী বাহিনীর প্রধান নন।’
‘মহামান্য আমীর, এ আমার কোন অপরাধের শাস্তি?’
‘সেনাবাহিনীর সামগ্রিক স্বার্থেই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। সৈনিক জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কারণে হেডকোয়ার্টার আপনার সেবা নিতে চাচ্ছে, এ-তো আপনার জন্য খুশির খবর। কেবল একটা বাহিনী নয়, আপনি কি চাননা আপনার অভিজ্ঞতা থেকে উপকৃত হোক আমাদের সকল সৈনিক?’
‘আমীর, আমার আশংকা হচ্ছে, সম্ভবতঃ আমার বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র চলছে। আপনার মহান ব্যক্তিত্ব এবং বুদ্ধিমত্তা দিয়ে একটু যাচাই বাছাই করবেন। আমার মনে হয় কেন্দ্রে আমার কোন শত্রু রয়েছে।’
‘দেখুন, সেনাবাহিনী এবং প্রশাসনের ভুল বুঝাবুঝি দূর করার জন্যই এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। অফিসার হোক কি সাধারণ সিপাই, এখন থেকে সকলের জন্য মদ নিষিদ্ধ। কোন অনুষ্ঠানে নাচগান চলবে না।’
‘কিন্তু মাননীয় আমীর! আমিতো হুজুরের অনুমতি নিয়েই সবকিছু করেছিলাম।’
‘আপনি যাদেরকে মুসলিম মিল্লাতের সেনাবাহিনী বলছেন, তাদের আসল চরিত্র দেখার জন্য নাচ গানের অনুমতি আমি দিয়েছিলাম। পঞ্চাশ হাজার সৈনিককে তো চাকুরীচ্যুত করতে পারছি না, এ জন্য মিসরের ফৌজের সাথে একীভূত করে ওদের সংশোধন করতে চাচ্ছি। মনে রাখবেন, আমরা কেউ সুদানী, মিসরী বা সিরীয় নই। আমরা সবাই মুসলমান। আমাদের ধর্ম এক, পতাকাও এক।’
‘আমার অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কি একবারও ভেবেছেন?’
‘দেখুন, এ সিদ্ধান্ত আপনার মনপুত না হলে আপনি সেনাবাহিনী থেকে ইস্তফা দিতে পারেন। আপনার ওপর আমি কোন কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না।’
‘মহামান্য আমীর, এ অন্যায়, এ জুলুম!’
‘কোনটা অন্যায় আর জুলুম তা বুঝার সাধ্যি কি আপনার আছে? নিজের অতীত একটু নিজেই তলিয়ে দেখুন গিয়ে, আমার মুখে শোনার প্রয়োজন হবে না।’
‘মহামান্য আমীর, এ সিদ্ধান্ত আরেকবার একটু বিবেচনার জন্য অনুরোধ করছি।’
‘অনেক ভেবেচিন্তেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ফিরে গিয়ে সব কিছু প্রস্তুত করুন। কোনরকম হটকারিতার আশ্রয় নেবেন না। মনে রাখবেন, আমার সহকারীর কাছে সাত দিনের মধ্যে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে হবে।’
নাজি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার মুখ খোলার আগেই কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী।
জুকি গভর্ণরের তাঁবুতে রাত কাটিয়েছে, নাজির গোপন হারেমেও এ সংবাদ পৌঁছে গিয়েছিল। ও এসেছে এই সেদিন, অথচ নাজি প্রথম দিন থেকেই অন্য সবার চাইতে ওকে বেশী ভালবাসে। এক মুহূর্তের জন্যও অন্য নর্তকীদের কক্ষে তাকে যেতে দেয়া হয়নি। জুকির জন্য ছিল আলাদা কক্ষ। নর্তকীরা প্রতিহিংসার আগুনে পুড়তে লাগল। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে ফাঁসানোর জন্য জুকিকে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে ওরা তা জানত না। ওদের ধারণা, জুকি নাজিকে এককভাবে দখল করে নিয়েছে। নর্তকী দু’জনের প্রতিহিংসা চরমে পৌঁছলে ওরা জুকিকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়।
গভর্ণরের তাঁবুতে জুকির রাত কাটানোর সংবাদে ওরা আরো পাগল হয়ে উঠল। কিভাবে তাকে হত্যা করা যায় ভাবতে গিয়ে ওদের মাথায় দুটি চিন্তা আসে। এক, তাকে বিষ প্রয়োগ করা যায়। দ্বিতীয়তঃ ভারাটে খুনী দিয়েও খুন করানো যায়। কিন্তু বাস্তবে দুটোর একটাও তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ জুকির খাওয়া দাওয়ার সবকিছু ছিল ওদের থেকে আলাদা, অন্যদিকে প্রহরী ছাড়া সে তার রুম থেকে বেরই হতো না।