বাইরে কারো পদশব্দে নাজি তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। তাঁবুর পর্দা তুলে তাকাল বাইরে। না, জুকি নয়, একজন সৈনিক যাচ্ছে। নাজি দৃষ্টি ছুঁড়ল আইয়ুবীর তাঁবুর দিকে। বাইরে রক্ষীরা টহল দিচ্ছে। ফিরে এসে এডরোসকে বলল, ‘এবার আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি আমার জুকি পাথর ভেঙেছে।’
রাতের শেষ প্রহর। সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল জুকি। নাজির তাঁবুর দিকে না গিয়ে হাঁটা দিল অন্য দিকে। পথে আপাদমস্তক ঢাকা একজন লোক দাঁড়িয়ে। লোকটি জুকিকে ইশারায় কাছে ডাকল, এগিয়ে গেল জুকি। লোকটি তাকে অন্য এক তাঁবুতে নিয়ে গেল। অনেকক্ষণ পর নাজির তাঁবুর দিকে হাঁটা দিল ও।
নাজির চোখে ঘুম নেই, ও একবার তাঁবুর ভেতরে ঢুকছিল, আবার বেরিয়ে আসছিল অস্থিরভাবে। কখনো হৃদয়ে তোলপাড় করা আনন্দ নিয়ে তাকাচ্ছিল আইয়ুবীর তাঁবুর দিকে। আকাশের উদার বিস্তার থেকে সালাহউদ্দীনকে তার পায়ের কাছে নামিয়ে এনেছে জুকি।
‘এডরোস, রাত তো শেষ হয়ে এলো, এখনো যে ও ফিরল না!’
‘ও আর কখনো ফিরে আসবে না। গভর্ণর তাকে সাথে নিয়ে যাবে। কোন রাজপুত্রও এমন হিরের টুকরো ফেলে দিতে পারে না, এদিকটা ভেবেছ কখনো?’
‘না তো! এদিকটা চিন্তাও করিনি।’
‘গভর্ণর তাকে বিয়েও তো করে নিতে পারেন! তাহলে মেয়েটা আমাদের কোন কাজেই আসবে না।’
‘ও যথেষ্ট সতর্ক।’
তবুও এক নর্তকীকে কদ্দুর বিশ্বাস করা যায়। নিজে অভিজ্ঞ পেশাদার নাচিয়ে। মা-ও বাঈজী ছিল। অবশ্যই সে আমাদের ধোঁকা দিতে পারে।’
গভীর চিন্তায় ডুবে গেল ওরা।
তাঁবুতে ঢুকলো জুকি। হেসে বলল, ‘এবার আমাকে আমার দেহের ওজন পরিমাণ স্বর্ণ দিন। ‘
‘কি হয়েছে আগে বলবে তো!’ নাজির কণ্ঠে অস্থিরতা।
‘আপনি যা চাইছিলেন তাই। আপনাকে কে বলল সালাহউদ্দীন পাথর, খোদার ভয়ে ভীত এক অনড় মুমীন।’ মাটিতে পা ঠুকে বলল জুকি, ‘সে মরুভূমির বালুর চাইতেও বেশী অসহায়, সামান্য বাতাসই তাকে উড়িয়ে নেয়ার জন্য যথেষ্ট।’
‘তোমার রূপের জৌলুস আর কণ্ঠের মধু তাকে উতলা করে দিয়েছে।’ এডরোস বলল, ‘নয়তো হারামিটা একটা দুর্গম পাথুরে পর্বত।’
‘পাথুরে পর্বত ছিল, এখন বালিয়াড়িও নয়।’
‘আমার ব্যাপারে কোন কথা হয়েছে?’ নাজির প্রশ্ন।
‘হ্যাঁ, জিজ্ঞেস করল নাজি লোকটা কেমন? আমি বলেছি, মিসরে আপনার বিশ্বস্ত এবং অনুগত কেউ থাকলে একমাত্র নাজিই রয়েছে।’
‘আমার সাথে পরিচয় কিভাবে জানতে চায়নি?’
‘চেয়েছে, বলেছি তিনি আমার পিতার অন্তরঙ্গ বন্ধু। আমাদের বাড়ী গিয়ে আব্বাকে বললেন, আমি সালাহউদ্দীনের নফর। তিনি যদি আমায় সাগরে ঝাঁপ দিতে বলেন, তাও আমি দিব।’
‘বাহাবা, বেশ বলেছ।’
‘আমার কথা শুনে তিনি বললেন, তুমি তো ভদ্রঘরের এক সম্ভ্রমশীলা তরুণী। আমি তাকে বললাম, অন্যের কাছে আমি যাই হই, আপনার কাছে আমি নগন্য এক দাসীমাত্র। আপনার ইশারাই আমার জন্য নির্দেশ।’
‘তারপর?’
‘আমার এ কথায় প্রভাবিত হয়ে তিনি বললেন, তুমি খুব ভাল মেয়ে। আরে অত দূরে কেন, আরেকটু কাছে এসে বসো। আমি খুব লজ্জিতভাবে জড়তা ও দ্বিধার ভাব নিয়ে তার পাশে গিয়ে বসলাম। আগে তিনি পাথর থাকলেও আমার দেহের স্পর্শে বলা যায় মোমের মত গলে গেছেন। বিদায়ের সময় আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে বললেন, জীবনে এই প্রথম পাপ করেছি। আমি বললম, আপনি কোন পাপ করেননি, প্রতারণা বা জোরাজুরিও করেননি। অন্যান্য শাসকদের মত জোর করেও ধরে আনেননি। আমি স্বেচ্ছায় এসেছি, আপনার অনুমতি পেলে আবারও আসব, বারবার আসব।’
নিজের নগ্ন দেহের মত অনেক মিথ্যা অবলীলায় বলে গেল জুকি। আনন্দের আতিশয্যে জুকিকে জড়িয়ে ধরল নাজি। এডরোস দু’জনকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল।
রহস্য ঘেরা মরুরাতের জঠর থেকে জন্ম নিল একটি প্রভাত, তবে অন্য প্রভাতের চেয়ে ভিন্ন। এ ভোরের আলো মরুরাতের আঁধার বুকে এমন এক নিগূঢ় তথ্য লুকিয়ে রাখল, যার মূল্য সমগ্র মুসলিম বিশ্বের সমান। গতরাতে ঘটে যাওয়া রহস্যের দুটি দিক ছিল। একটি জানত নাজি এবং এডরোস। দ্বিতীয়টি আইয়ুবীর দেহরক্ষীরা। আর দু’টি দিকই জানতেন আলী বিন সুফিয়ান, আইয়ুবী এবং জুকি।
সালাহউদ্দীন এবং তার সঙ্গীদের অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে বিদায় দিয়েছিলেন নাজি। দুই সারিতে দাঁড়িয়ে ছিল সুদানী ফৌজ। ‘সালাহউদ্দীন আইয়ুবী জিন্দাবাদ’ এর ধ্বনিতে প্রকম্পিত হল আকাশ বাতাস। কিন্তু আইয়ুবী মৃদু হাসি বা হাত নেড়ে এ অভিবাদনের কোন জবাব দিলেন না।
নাজির সাতে হাত মিলিয়ে দ্রুত ঘোড়ায় চেপে বসলেন তিনি। তাকে অনুসরণ করল অন্য সংগীরা। অফিসে গিয়ে আলী এবং একজন সহকারীকে নিয়ে কক্ষের দরজা বন্ধ করে দিলেন তিনি। দিন কাটলালেন রুদ্ধদ্বার কক্ষে।
সুর্য ডুবে গেল। রাতের অন্ধকার গ্রাস করল পৃথিবী। কিন্তু তিনি রুদ্ধদ্বার কক্ষের দরজা খুললেন না। কক্ষে খাবার বা পানি দেয়ারও সুযোগ দিলেন না কাউকে। অনেক রাতে তিনজন কক্ষ থেকে বেরিয়ে নিজ নিজ ঘরের দিকে হাঁটা দিলেন।
আলী বিন সুফিয়ান একা হতেই কমাণ্ডার তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
‘জনাব’ অভিমান ভরা কমাণ্ডারের কণ্ঠ, ‘নির্দেশ পালন করা এবং মুখ বন্ধ রাখা আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু আমার সিপাইদের মধ্যে অসন্তুষ্টি আর নৈরাশ্য ছড়িয়ে পড়েছে। আমরাও একই অবস্থা।’