আমি কি জানি?
কথাটা ঘরে থেকে শুনেই গৌরী তৎক্ষণাৎ গিয়ে জানালার পর্দ্দা সরিয়ে দাঁড়াল।
ঠাকুমা বললেন, আসে না কেন?
জ্বর।
জ্বর কথাটা নীতীশকে মোটেই বিচলিত করল না, ও জানে, ওটা একটা ফাঁকি ছাড়া আর কিছু নয়।
টাকাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল জুতোজোড়া আনতে, রাস্তা থেকে টাকাটা ভাঙিয়ে নিলে, কারণ হারিয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়, প্রতি মোড়ে মোড়ে গুণে দেখতে লাগল পয়সা ঠিক আছে কিনা।
জুতোর দোকানে ঢুকেই বললে, দিন তো মশাই সেই লাল জুতো; সেই যে সেদিন দেখে গিয়েছিলুম?
দোকানদার একজোড়া দেখালে। ও বললে, না–না, এটা নয়, দেখুন তো ওই শেলফে?
পাওয়া গেল সেই স্বপ্নময় জুতো! কি জানি কেন আরো ভাল লাগল–ওর মধ্যে কি যেন লুকিয়ে আছে। চিত্তের মধ্যে একটি হিংস্র আনন্দ দেখা দিল–দর নিয়ে গোল বাধল না, একটি টাকা দিয়ে জুতোজোড়া নিলে জুতোওয়ালা বললে, আবার আসবেন। মনে হল বোধহয় ঠকিয়েছে।
রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে অনেক বার ইচ্ছে হল বাক্সটা খুলে দেখে–কিন্তু পারল না। একবার মনে হল, এ দিয়ে কি হবে? কার জন্যেই বা কিনল? সে কি পাগল! মিথ্যে মিথ্যে টাকা তো নষ্ট হল?
ভিতর হতে কে যেন উত্তর দিল, ‘কেন, টুটুলের পায় যদি হয়?’ টুটুলের কথা মনে হতেই একটু ভয় হল, যদি তার পায় সত্যিই হয়, তাহলেই তো হয়েছে। আবার প্রশ্ন, কিন্তু কার জন্যে সে কিনেছে? বেশ ভাল লাগল বলে কিনেছি! ভাল লাগে বলে তো মানুষ অনেক কিছু করে, বাজী পোড়ায়, গঙ্গায় গয়না ফেলে–এ তবু, একজোড়া জুতো পাওয়া গেল। তো! বাজে খরচ হয় নি, বেশ করেছে, একশো বার কিনবে। সহসা জিহ্বায় দাঁতের চাপ লাগতেই মনে পড়ল, কেউ যদি মনে করে তাহলে জিব কাটে, কে মনে করতে পারে? গৌরী? আজি গৌরীকে ডেকে দেখতে হবে।
বাড়িতে পৌঁছে, সকলকে মূল্যবান জিনিসটা দেখাতে ইচ্ছে করছিল,কিন্তু সাহস হল না, মুক্ত করে? প্রথমত সে নিজেই ঠিক করতে পারছে না–কার জন্যে কিনল, কেন কিনল?
টুটুল বারান্দায় তখন খেলা করছিল, তার পায়ের মাপটা নিয়ে জুতোটা মেপে দেখল, টুটুলের পা কিঞ্চিৎ বড়–কিন্তু ওর মনে হল অসম্ভব বড়! শঙ্কিত চিত্তে ঠাকুমার কাছে গিয়ে বললে, তোমাদের সেই লাল জুতোর কথা বলেছিলুম, এই দেখ।
ভাঁড়ার ঘর হাসি উচ্ছলিত। ঠাকুমা বললেন, ওমা—কোথা যাব, ছেলে না হতেই জুতো! হৈ হৈ পড়ে গেল। নীতীশের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল, বললে আমি টুটুলের জন্যে এনেছিলুম…
কে শোনে তার কথা! বুঝতে না পেরে, পড়ার ঘরে গিয়ে আলোটা জেলে বাসল, সামনে জুতো জোড়া, প্রাণভরে দেখতে লাগল। এ দেখা, যেন নিজেকে দেখা। ভাবলে, গৌরীকে কি করে ডাকা যায়?
গৌরী গোলমাল শুনে, জানলায় এসে দাঁড়িয়ে দেখছিল–ব্যাপারটা কি সে বুঝতে পারে নি। মনে হচ্ছিল, নীতীশ একবার ডাকে না?
সহসা চিরপরিচিত ইশারায়–না থাকতে পেরে নেমে এল, আসতেই নীতীশ বললে, তোমায় একটা জিনিস দেখাব, দাঁড়াও।
গৌরী উদগ্ৰীব হয়ে ওর দিকে চাইল। নীতীশের শার্ট বোতাম–হীন দেখে বললে, তোমার গলায় বোতাম নেই, দেব?
দাও।
গৌরীর চুড়িতে সেফটিপিন ছিল না, শুধু একটি ছিল ব্লাউজে, বোতামের পরিবৰ্ত্তে—না ভেবেই সেটা দিয়ে বুঝল ব্লাউজ খোলা, বললে,–দাও। ওটা, তোমায় একটা এনে দিচ্ছি।
থাক।
থাক কেন, এনে দিই না? কাতর কণ্ঠে বললে।
থাক, বলে হাসিমুখে সে জুতোর বাক্সটা খুলে গৌরীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলে, তার মুখ আনন্দে উৎফুল্প।
সুনিবিড় প্রেমে কালো চোখ দুটো স্বপ্নময় হয়ে এল। গৌরী জুতোজোড়া দেখে, কেঁপে উঠল! তার দেহে বসন্ত মধুর শিহরন খেলে গেল। মনে হল, এ যেন তারই শিশুর জুতো! অস্পষ্টভাবে বললে, আঃ–! তার দেহ আনন্দে শিথিল হয়ে আসছিল। যেন কোন রমণীয় সুখ অনুভব করে, আবার বললে, আঃ।…সব কিছু যেন আজ পূর্ণ হল। নিজেদের কল্পনায় যে সুন্দর ছিল, যেন তাকেই রূপ দেবার জন্যে আজ। দুজনে আবদ্ধ হল।
নীতীশ বিস্ময় ভরে দেখে ভাবছিল একি! পাশের বাড়িতে তখন সেতারে চলছিল তিলক-কামোদের জোড়–তারই ঘন ঝঙ্কার ভেসে আসছিল। ওই সমীত এবং এই জীবনের মহাসঙ্গীত তাদের দুজনকে আড়াল করে রাখলে, হিংস্র বাস্তবের রাজ্য থেকে। যে কথা অগোচরে অন্তরের মধ্যে ছিল, সে আজ দুলে।-দুলে উথলে উঠল। বহু জনমের সঞ্চিত মাতৃস্নেহ-মাতৃত্ব।
দেখতে পেলো, সুন্দর অনাগত শিশু, যে ছিল তার কল্পনায়; অঙ্গটি তার মাতৃস্নেহের মাধুৰ্য্য দিয়ে গড়া, যাকে দেখতে অবিকল নীতীশের মত; তার আত্মা যেন শিশুর তনুতে তনু নিল। ইচ্ছে করল। বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে–বুকে জড়িয়ে ধরে বেদনা-।মাখা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়তে। জুতো দুটোয় আস্তে আস্তে হাত বুলোতে বুলোতে সহসা গভীর ভাবে চেপে ধরল, তারপর বুকের মধ্যে নিয়ে যত জোরে পারে তত জোরে চেপে, সুগভীর নিশ্বাস নিলে, মনে হল যেন তার সাধ মিটেছে। ভগ্নস্বরে কণ্ঠ হতে বেরিয়ে এল, আঃ…
আনন্দে বিস্ফারিত আঁখিযুগল। নিজেকে যেন অনুভব করলে। আজ শান্ত হল তার লক্ষ বাসনা লক্ষ বেদনা–লক্ষ স্বল্প মূৰ্ত্তি পেল।
বিশ্বাগত অপূর্ণতা তারা এই তরুণ বয়সেই উপলব্ধি করলে; পূর্ণতার সম্ভাবনায় দুজনেই মহ-আনন্দ-মদে মত্ত হয়ে উঠল।
গৌরীর হৃদয়ের ভিতর দিয়ে, ওই লাল জুতো পরে, নীতীশ টলমল করে চলল, আর–গৌরী চলতে শুরু করলে, নীতীশের হৃদয়ের মধ্যে দিয়ে পথ করে। আচন্বিতে সশব্দে জুতোজোড়াকে চুম্বন করলে। তারপর নীতীশের দিকে চেয়ে, ঈষৎ লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠে। জিগগেস করলে, কার জন্যে গো?