গৌরী সন্ধেবেলায়, প্রায় অন্ধকার বারান্দায় বসে, রূপোর ঝিনুকে করে তাকে দুধ খাওয়াবে; ঝিনুকটা রূপোর বাটিতে বাজিয়ে বাজিয়ে বলবে, আয় চাঁদ আয় চাঁদ–কি মধুর। আকাশে তখন দেখা দেবে একটি তারা।…আমায় বাবা বলে ডাকবে, শুনতে পেল–ছোট দুটি বাহু মেলে আধো–আধো গদগদভাবে ডাকছে, বাবা–হাতে দুটি সোনার বালা। দেখতে যেন পেল, গৌরী তাঁকে পিছন থেকে ধরে দাঁড় করিয়েছে, মাঝে-মাঝে শিশু টাল সামলাতে পারছে না, উল্লাসে হাতে হাত ঠেকছে, হাসি উচ্ছল মুখ। আমি হাত দুটো
ধরে বলব, ‘চলি-চলি পা-পা টালি-টালি যায়, গরবিনী আড়ে আড়ে হেসে হেসে চায়. কি নাম হবে? গৌরী নামটা পৃথিবীর মধ্যে নীতীশের কাছে মিষ্টি, কিন্তু ও নামটা রাখবার উপায় নেই,লক্ষ লক্ষ নাম মনে করতে করতে সহসা নিজের লজ্জা করতে লাগল, ছিছি। সে কি যা–তা ভাবছে! কিন্তু আবার সেই বাহু মেলে কে যেন ডাকল–’বাবা।’
না, ছেলেমেয়ে বিশ্ৰী, ‘বিশ্ৰী’ শুধু এই ওজর দিয়ে প্রমাণ করতে হল যে—যদি টুটুলের মত মধ্যরাতে চীৎকার করে কেঁদে উঠে–উঃ কি জ্বালাতন!
যে জুতো দেখে ওর মন চঞ্চল হয়ে উঠেছিল, ইচ্ছে হচ্ছিল সেই লাল জুতো–জোড়ার কথা সকলকে বলে, কিন্তু সঙ্কোচও আছে যথেষ্ট, পাছে গৌরীকে নিয়ে যা কল্পনা করেছে তা প্রকাশ হয়ে পড়ে। যদিও প্রকাশ হবারকোনও সম্ভাবনাছিল না, তবুও মনে হচ্ছিল, হয়ত প্ৰকাশ হয়ে যেতে পারে। একেই তো গৌরী এলে, ঠাকমা থেকে আরম্ভ করে বাড়ির সকলে ঠাট্টা করে। ঠাট্টা করার কারণও আছে; একদা স্নানের পর তাড়াতাড়ি করে নীতীশ ভাত খেতে গেছে, ঠাকুমা বললেন–নীতীশ তোর পিঠময় যে জল, ভাল করে গাটাও মুছিস নি? পাশেই গৌরী দাঁড়িয়েছিল, সে অমনি আঁচল দিয়ে গাটা মুছিয়ে দিলে পরম স্নেহে–অবশ্য নীতীশ তখন ভীষণ চটেছিল। এই রকম আরও অনেক ব্যাপার ঘটেছিল যাতে করে বাড়ির মেয়েদের ধারণা, নীতীশের পাশে গৌরীকে বেশ মানায়–বিয়ে হলে ওরা সুখী হবে এবং তাই নিয়ে ওঁরা ঠাট্টাও করেন।
কি করে, আর কাউকে না পেয়ে নীতীশ তার বড়বোঁদিকে বললে, জানো বড়বেদি, আজ যা একজোড়া জুতো দেখে এলুম, ছোট্ট জুতো, টুটুলের পায়ে বোধহয় হবে।–কি নরম, তোমায় কি বলব! দাম মাত্র একটাকা! অবশ্য নীতীশের ভীষণ আপত্তি ছিল টুটুলের নাম করে আমন সুমধুর ভাবনাটাকে মুক্তি দেওয়ায়, কিন্তু বাধ্য হয়ে দিতে হল।
বৌদি বললেন, বেশ, কাল আমি টাকা দেব’খন–তুমি এনে দিও।
মনটা ভয়ানক ক্ষুন্ন হল, কি জানি সত্যি যদি আনতে হয়–শেষে কিনা টুটুলের পায় ওই জুতোজোড়া দেখতে হবে! তবে আশা ছিল এইটুকু যে, বৌদি বলার পরই সব কথা ভুলে যান।
নীতীশ পড়ার ঘরে গিয়ে বসল। পড়ায় আজ তার কিছুতেই মন বসছিল না, সর্বদা ওই চিন্তা। তার কল্পনা অনুযায়ী একটি শিশুর মুখ দেখতে ভয়ানক ইচ্ছে হল–এ বই সে বই ঘাঁটে, কোথাও পায় না, যে শিশুকে সে ভেবেছে তার ছবি নেই।–কোথায়? কোথায়?
হঠাৎ পাশের ঘর থেকে গৌরীর গলা পাওয়া গেল, অস্বাভাবিক কঠে। সে কথা বলছে। প্রতিবার ঝগড়ার পর নীতীশ এ ব্যাপারটাকে লক্ষ্য করেছে, গৌরীকে সে বুঝতে পারে না। হয়ত গৌরী আসতে পারে, এই ভেবে সে বইয়ের দিকে চেয়ে বসে রইল।
উদ্দাম দুর্ব্বার বাতাসে ত্রাসে কেঁপে ওঠে যেমন দরজা জানলা, গৌরী প্রবেশ করতেই পড়ার ঘরখানা তেমনি কেঁপে উঠল। হাসতে হাসতে ওর কাঁধের উপর হাত দিয়ে বললে, লক্ষ্মীটি আমার উপর রাগ করেছ?
কথাটা কানে পৌঁছতেই রাগ কোথায় চলে গেল!
রাগের কারণ আছে। গৌরী ফোর্থ ক্লাসে উঠে ভেবেছে যে সে একটা মস্ত কিছু হয়ে পড়েছে–অঙ্ক কি মানুষের ভুল হয় না? হলেই বা তাতে কি? প্রথমবার নয় পারে নি, দ্বিতীয়বার সে তো রাইট করেছে। না পারার দরুন গৌরী এমনভাবে হাসতে লাগল এবং এমন মন্ত্র উচ্চারণ করলে যে অতি বড় শান্ত ভদ্রলোকেরাও ধৈৰ্য্যচ্যুতি ঘটে, নীতীশের কথাতো বাদই দেওয়া যাক।
নীতীশের রাগ পড়েছিল, কিন্তু সে মুখ তুলে চাইতে পারছিল না; সেই কল্পনা তার মনের মধ্যে ঘুরছিল।
রাগ করেছ? আচ্ছা আর বলব না, কক্ষনো বলব না–বাবা বলিহারি রাগ তোমার। কই আমি তো তোমার উপর রাগ করি নি?
মানে? আমি কি তোমায় কিছু বলেছি যে রাগ করবে?
গৌরীর এই সব কথাগুলো শুনলে ভারী রাগ ধরে, কিছু বলাও যায় না।
চুপ করে আছ যে? এই অঙ্কটা বুঝিয়ে দাও না ভাই…
অঙ্ক-টঙ্ক হবে না—
লক্ষ্মীটি তোমার দুটি পায়ে পড়ি।
এতক্ষণ বাদে ওর দিকে নীতীশ চাইল। ওকে দেখে বিস্ময়ের অবধি রইল না, সেই শিশুর মুখ; যাকে সে দেখেছিল নিজের ভিতরে, অবিকল গৌরীর মতই ফর্সা–ওই রকম সুন্দর চঞ্চল, কাল চোখ!
কি দেখছি?
লজ্জা পেয়ে ওর অঙ্কটা করে দিলে। তারপর নানান গল্পের পর, লাল জুতো–জোড়ার কথা ওকে ব’লে বললে, কি চমৎকার! মনে হবে তোমার সত্যি যেন ছোট্ট ছোট্ট দুটো পা।
ছোট্ট দুটি চরণ কল্পনা করে গৌরীর বুকও অজানা আনন্দে দুলে উঠল—যে আনন্দ দেখা দিয়েছিল নীতীশের মনে। গৌরী বললে, আচ্ছা কাল তোমায় আমি পয়সা দেব, আমার টিফিনের পয়সা জমানো আছে–কেমন?
নীতীশ ভদ্রতার খাতিরে বললে, তোমার পয়সা আমি নেব কেন?
কথাটা গৌরীর প্রাণে বাজল, সে অঙ্কের খাতাটা নিয়ে, বিলন্বিত গতিতে চলে গেল। নীতীশ অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে রইল।
দিন-দুয়েক গেল পয়সা সংগ্রহে। এই দুদিনের মধ্যে গৌরী এ বাড়ি আর আসেনি। ঠাকুমা জিগগেস করলেন, নীতীশ, গৌরী আসে না কেন রে?