- বইয়ের নামঃ গল্পসমগ্র
- লেখকের নামঃ কমলকুমার মজুমদার
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
লাল জুতো
গৌরীর সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার দরুন কিছু ভাল লাগছিল না। মনটা বড় খারাপ,–নীতীশ ভাবতেই পারছে না, দোষটা সত্যিই কার। অহরহ মনে হচ্ছে–আমার কি দোষ? জীবনে অমন মেয়ের সঙ্গে সে কখনই কথা বলবে না।
দক্ষিণ দিককার বারান্দা দিয়ে যতবার যায় ততবারই দেখে, গৌরী পর্দ্দা সরিয়ে এদিক পানে চেয়ে আছে, ওকে দেখলেই পলকে পর্দ্দা ফেলে দেয়। এ চিন্তা থেকে মুক্তি পাবার জন্যে মনটা সদা চঞ্চল হয়ে রয়েছে; কি করে, কোথায় বা যায়? কোন কাজেই মন টিকছে না! অবশেষে বিকেল বেলা মনে পড়ল–জুতো জোড়া নেহাৎ অসম্মানজনক হয়ে পড়ছে, অনেক অনুনয়-বিনয় করে ঠাকুমার কাছে ব্যাপারটা বলতে–টাকা পাওয়া গেল।
নিজের জিনিস নিজে কেনার মত স্বাধীনতা বোধ হয়। আর কিছুতেই নেই, অথচ মুসকিলও আছে যথেষ্ট। যদিও সরকার মশায়ের গ্রাম্য পছন্দের আওতায় নিজের একটা স্বাধীন পছন্দ গড়ে উঠেছিল, কিন্তু তাকে বিশ্বাস নেই–কি জানি যদি ভুল হয়? যদি দিদিরা বলে, ‘ওমা এই তোর পছন্দ?’ সিদ্ধান্ত যদি হয়–’তা মন্দ কি বাপু বেশ হয়েছে, ঘষে মেজে অনেক দিন পায় দিতে পারবে ’খন!’ এর চাইতে গুরু শ্লেষ আর কি হতে পারে? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে নীতীশ রাস্তা দিয়ে চলেছে। ছোট দোকানে যে তার পছন্দসই জুতো পাওয়া যেতে পারে না, এ ধারণা তার বদ্ধমূল, তাই বেছে বেছে একটা বড় দোকানে গিয়ে উঠল। জুতোওয়ালা এমন করে কথা বলে, যে তার উপর কথা বলা চলে না, মনে হয় যেন ওকথাগুলো নীতীশের। যে জুতোজোড়া পছন্দ হল, সেটা সোয়েড আর পেটেন্ট লেদারের কম্বিনেশান। ক্লাসের ছেলেরা হিংসে করে মাড়িয়ে দিতে পারে, গৌরীর মনে হতে পারে, কেন ছেলে হয়ে জন্মালুম না?
দাম ছ-টাকা; ঠিক পাঁচ টাকাই তার কাছে আছে। দর-কষাকষি করতে লজ্জা হয়, পছন্দ হয়নি বলে যে অন্য দোকানে যাবে তারও জো নেই, কারণ শুধু তার জন্যে অতগুলো বাক্স নামিয়ে দেখিয়েছে। আজকাল তো সবকিছুই সস্তা, কিছু কম বললে দেয় না? ইচ্ছে আছে, কিছু পয়সা যদি সম্ভব হয় তো বাঁচিয়ে একখানা মোটা খাতা কিনবে, গৌরীর হাতের লেখা ভাল, ভাব হলে, তার উপর সে মুক্তোর মত অক্ষরে বসিয়ে দেবে–নীতীশ ঘোষ–সেকেণ্ড ক্লাস…অ্যাকাডেমি।
লজ্জা কাটিয়ে বলে ফেললে, সাড়ে চারে হয় না?
জুতোওয়ালা বললে, আপনার পায়ে চমৎকার মানিয়েছে, একবার আয়নায় দেখুন না, দরাদরি আমরা করি না।
নীতীশ পিছন ফিরে আয়নার দিকে যেতে গিয়ে দেখে, নিকটে এক ভদ্রলোক বসে আছেন, যার বয়েস সে আন্দাজ ঠিক করতে পারে না, তবে তার দাদার মত হবে; যাকে আমরা বলব আটাশ হতে তিরিশের মধ্যে; তাঁর হাতে ছোট্ট ছোট্ট দুটি জুতো, কোমল লাল চামড়ার। দেখে ভারী ভাল লাগল–জুতোজোড়া সেই নরম কোমল পায়ের, যে পা দুখানি আদর করে স্নেহভরে বুকে নেওয়া যায়, সে চরণ পবিত্র, সুকোমল, নিষ্কলুষ।
সহসা যেমন দুর্ব্বার দখিন হাওয়া আসে, তেমনি এল অজানা মধুর আনন্দ, ওইকিশোর নীতীশের বুকের মধ্যে। ছোট লালজুতো দেখলে ওর যে বিপুল আনন্দ হতে পারে, এ কথা ওর জানা ছিল না–জানতে পেরে আরও খুসী হল, খুসীতে প্ৰাণ ছেয়ে গেল। ইচ্ছে হল, জুতো জোড়া হাতে করতে, ইচ্ছে হল হাত বুলোতে। কোন রকমে সে লজ্জা ভেঙে বললে, মশাই দেখি, ওই রকম জুতো।
ক-মাসের ছেলের জন্যে চান?
ভীষণ সমস্যা, কী–মাসের ছেলের জন্যে চাইবে? বললে, ছ-সাত, নানা, আট-দশ মাসের আন্দাজ।
একটি ছোট বাক্স, তার মধ্যে ঘুমন্ত দুটি জুতো, কি মধুর। নীতীশের চোখের সামনে সুন্দর দুটি মঙ্গলাচরণ ভেসে উঠল। মনে হল, ও পা দুটি তার অনেক দিনের চেনা, অনেক স্বপ্নমাখা আনন্দ দিয়ে গড়া। হাসি চাপিতে পারলে না, হাসি যেন ছুটে আসছে, না হোসে থাকতে পারল না।
মনে করতে লাগল, কার পায়ের মত? কার পা? কিছুতেই মনে আসছে না, টুটুল? না–টুটুল তো বেশ বড়। ইচ্ছে হল জুতোজোড়া কিনে ফেলে। জিগগেস করল, ওর দাম?
এক টাকা। নিজের টাকা দিয়ে কিনতে ইচ্ছে হল, কিন্তু সাহস হল না। কিন্তু উদ্বৃত্ত টাকাও যে তার কাছে এখন নেই, হয়তো কিছু সস্তায় হতে পারে। কি করা যায়, ‘কি হবে কিনে?’ বলে বিদায় দেওয়া যায় না? যাক টাকা পেলে কেনা যাবে। নিজের জুতো কেনাও হল না, দরে পোষাল না বলে। যখন সে উঠতে যাচ্ছে, তখন তার মনে হল, পিছন থেকে জুতো জোড়া তাকে টানছে, বিপুল তার টান! যেন ডাকছে, কি মোহিনী শক্তি ৷ একবার মনে হল কিনে ফেলে, কি আর বলবে, বড়জোড় বকবে, তবুও সাহস হল না।
চিরকাল সে ছোট ছেলে দেখতে পারে না, ছোট ছেলে তার দু-চক্ষের বিষ, ভেবেই পেত না টুলকে কি করে বাড়ির লোকে সহ্য করে…কি করে লোকে ছোট ছেলেকে কোলে নেয়? নিজের ওই স্বভাবের কথা ভেবে লজ্জা হল, তবু–তবু ভাল লাগছিল, যতবার ভুলবার চেষ্টা করে ততবার ভেসে আসে সেই লাল জুতো–মধুর কল্পনা পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে সেই লাল জুতোর পানে দেখে সে আন্তে আস্তে দোকান থেকে বার হয়ে এল।
রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কত অসম্ভব কল্পনাই না তার মনে জাগছিল। তার মনে তখন, পিতা হবার দুৰ্ব্বার বাসনা। গৌরীর সঙ্গে যদি বিয়ে হয়, তাহলে? বেশি ছেলে মেয়ে সে পছন্দ করে না, একটি মেয়ে সুন্দর ফুটফুটে দেখতে, কচি–কচি হাত পা, মনের মধ্যে অনুভব করল, যেন একটা কচি—কচি গন্ধও পেল।