প্ৰবীণা একটি পঞ্চাশ টাকার নোট কোলে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘গোপাল আমার লজেঞ্চুস খেয়ো। আর একটি ধরে দিকি। এই মুখপোড়া ট্রেনে একটাও কি ভাল কথা আছে।’
প্ৰবীণা অতি সরল। জানেন না, কার সঙ্গে কথা কইছেন, যাঁর এক আসরের প্রণামী দশ, বারো হাজার। তবে ট্রেনে তো কিছুই করার নেই। তাই বোধহয় গান ধরলেন,
আমি প্রেমের ভিখারি।
কে প্ৰেম বিলায় এ নদীয়ায় ৷
প্ৰবীণা আবেগে ফেঁসে ফোঁস করছেন, আর আমি করছি রাগ। সাড়ে পাঁচশো পা থেকে খুলে নিয়ে গেছে। পথিবী কি টেরিফিক জায়গা!
শ্রীচৈতন্য, শ্ৰীঅচৈতন্য, সব এক ঠাঁয়ে কেলাকুলি। পকেট আর পকেটমার পাশাপাশি।
গানান্তে দুভাঁড় প্লাটফর্ম চা পান করে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে সঙ্গীতগুরু জুতো প্রসঙ্গে ফিরলেন। জানলার ধারে গম্ভীর চেহারার এক ভদ্রলোক বেপরোয়া কলা খেয়ে চলেছেন। আর একটা হলেই ডজন কমপ্লিট। গতিশীল হলে অনেকের ক্ষিদে বাড়ে।
সঙ্গীতগুরু বললেন, ‘ওই জন্যেই চটি পরাই ভালো। এই যে আমার পায়ে চটি, এটা আমার কি না, বুকঠুকে বলতে পারব না। অনেক আসরই আমাকে মারতে হয়। ডায়াস থেকে নেমে এসে যেটা সামনে পাই সেইটাই গলিয়ে চলে আসি। সেই কারণে আজ আমার পায়ে নতুন জুতো, তো কাল পুরনো। কোনোদিন আধা ইঞ্চি বড়, তো কোনদিন আধা ইঞ্চি ছোট। আমার ধারণা, প্রায় সবাই অন্যের জুতোয় পা গলাবার চেষ্টা করছে।’
শেষ কলাটি সাঙ্গ করে জানলার ধারের গম্ভীর ভদ্রলোক বললেন, দার্শনিকের কথাই বললেন, ‘অন্যের জুতোয় পা ফিট করতে করতেই জীবন ফোত হয়ে গেল। আপনি কি গায়ক?’
—’সেই রকম একটা পরিচিতি কলকাতায় আমার আছে। আপনার?’
—’উত্তর ভারতে আমাকে সবাই তবলিয়াই জানে। রোজ সকালে আড়াই ঘণ্টা কুস্তি করি। আর সারারাত তবলা পিটি। পৃথিবীর সব তালই আমার জানা। এখন সব ঝাঁপতালে চলছে। আড়াঠেকা খুব পপুলার। আর সংসারে আধাধা। সব কিছুই আধ্ধা। যাক, জুতোটা ছাড়ুন, টয়লেটে যাব।’
শিল্পী অবাক-’তার মানে?’
—মানে এই, যে জোড়ায় পা চালিয়ে বসে আছেন সেটা আমার, আর আপনারটা আমার পায়ে। আপনারটা পাঞ্জায় ছোট, আমারটা বড়।
জুতোর যন্ত্রণা শেষ হল। জুতাতঙ্কের মতো বিমলবাবুর ডাকাতাতঙ্ক। যথেষ্ট থাকার এই বিপদ। একতলা তিনতলা হয়ে টাওয়ার হাউস। এক কাঠায় পাশে বাড়া যাবে না বলেই আকাশে ফলাও। গ্রিল আর কোলাপসিবলের খাঁচা।। ঘরে ঘরে দামী আসবাবের গতৌগতি। বেশ খোলা মনে উদার হয়ে হাঁটতে গেলে পায়ের বুড়ো আঙুলের নখের মাথা উলটে যাবে। যেন গাড়ির বনেট খুলে গেল। যেটুকু আলো আসার উপায় ছিল দামী পর্দার দাপটে বাইরেই পড়ে রইল। জিভ দিয়ে পর্দা, চোটে পশ্চিমে ফিরে যায়।
পয়সার সঙ্গে আর যা যা আসা উচিত সবই এসে গেছে। দামড়া” এক অ্যালসেশিয়ান। ছেড়ে রাখার উপায় নেই। সে একবার পাশ ফিরলে সব উলটে পড়ে যায়! লেজ নেড়ে আহ্বাদ প্রকাশ করার খরচ, চার, পাঁচ, হাজার। গণেশ গেল গেল, ভি সি আর চিৎপাত, কালার টিভি খিল খুলে ভূপতিত।
বাইরে চল্লিশ। দগ্ধ দীপ্ৰ দিন। অন্দরে একই সঙ্গে চেনে বাঁধা কুকুরের চিৎকার, পাম্পের গর্জন আর চারশো আশির পাওয়ার হাউসে বিটের শব্দ, ধাম ধাম, রান্নাঘরে শুকনো লঙ্কার ফোড়ন, কোণের ঘরে টিভির। উদ্বেগ, অটল অটলই থাকবেন, না। টলে যাবেন।
আর পরিবারের নিঃসঙ্গ বদ্ধটি ছাতে সামান্য একটু ছায়ার আশ্রয়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। পাওয়ার হাউসের শব্দে বাড়ি কাঁপছে। গৃহাশ্ৰিত বেড়ালটির তিনটি বাচ্চা হয়েছে। চোখ ফোটেনি, চুকুর চুকুর স্তন চুষছে।
ফালি ফালি তালি তালি
বড় ম্যানেজ করা গেল না বলে, কেটে ছেটে মাপে নিয়ে আসা হল। থিঙ্ক বিগ, বইয়ের উপদেশে মজুত থাক, যেমন আছে, যেমন থাকবে চিরকাল। মানবের বৃহৎভাবনা সমূহ। বাস্তবের কথা হল, থিঙ্ক ম্যানেজেবল স্মল। ছোট করে নাও। ভেতরে অন্তত বাইরে ডোবা সেই ডোবায় কোলা ব্যাঙ, গ্যাঙের গ্যাং।
বড় পরিবার ইতিহাস। একান্নবর্তী চকমেলান বাড়ি। হাওদা হাওদা ঘর, দালান, উঠোন, বড়, মেজ, সেজ, ছোট, ন, রাঙা, ফুল, কত্তায় কত্তায় ক্ল্যাশ, বউদের খিল খিল গুলতানি, ডজনখানেক বাচ্চার কিচির মিচির। ছাতের আলসেতে সপাটে ঝুলন্ত গোটা চোদ্দ রংবাহারি শাড়ি, যেন ইন্টারন্যাশানাল অলিম্পিক ভিলেজ। লিঙ্গরখানার মতো রান্নাঘরে সার সার গনগনে হাওদা উনুন, মন মন কয়লা, পাহাড়ের মতো ছাইগাদা, তার ওপর ল্যাজমোটা থুপসি তুলো মৎস্যচিন্তায় ধ্যানস্থ। পরিবারের প্রিয়। আদুরে নাম জর্দা, কারণ মেজকত্তা তাকে কিলাপাতি জর্দার মৌজ ধরিয়েছেন। একটা রামপুরিয়া কুকুর আছে ছানাপোনা-সহ। সে ভিজে আলোচাল মশ মশ করে খায়।
পাকা পেয়ারার মতো ঠাকুরদা সাদা। ফতুয়া পরে বাইরের ঘরে ঢালাও ফরাসে বসে বয়স্যদের সঙ্গে শিয়াখালার আমবাগানে ল্যাংড়া আমের গল্প করছেন। অ্যাটি কেমন পাতলা, না তাঁর গিন্নির যৌবনকালের নাকের মতো যেখানে তিলফুলের মতো জ্বলজ্বল করত হীরের নাকছবি। গাত্রবর্ণ দুধে আলতা বললে সবটা বলা হল না, তার সঙ্গে আর একটি বিশেষণ যোগ করতে হবে, সে-রেসেন্ট। বিশাল ময়ুরপঙ্খী খাটের ঠিক কোন জায়গাটায় আছেন তিনি, রাতের অন্ধকারে কী ভাবে লোকেট করা যাবে?
বয়স্যদের সঙ্গে বৃদ্ধিকালে রসের কথা আসতেই পারে। আমি অতি রসাল, গৃহিণী ততোধিক। নাবিক লাইট হাউসের আলোর নিশানায় জাহাজ কুলে ভেড়ায়, ঠিক সেইরকম। নাকছবির হীরে ঝিলিক মারছে, গোড়ালির দ্যুতি, আঙুলের বিজলি, ওই তো আমার বন্দর।।