বড় বড় কথা! আপনি নিজে কী? তাহলে শুনুন। এলিয়ট সায়েবের দুচরণ কবিতা:
We are the hollow men
We are the stuffed men
Leaning together
Headpiece filled with straw. Alas!
কি জ্বালা
দমকা টাকায় বিমলবাবু বেসামাল। কোথা থেকে এল, কি ভাবে এল, সে রহস্যের সন্ধান না করাই ভাল। টাকা হল সালঙ্কারা, সুন্দরী রমণীর মতো। কার হাত ধরে গলায় মালা পরাবে কেউ বলতে পারবে না। ভদ্রলোক নিজেই রহস্যময়। অর্ধসমাপ্ত একতলা একটা বাড়ি কিনে নতুন পাড়ায় সংসার সাজালেন। সবাই ভেবেছিল, নতুন পাড়ায় যখন এসেছেন, তখন সকলের সঙ্গে যেচে আলাপ পরিচয় করে পাড়াভুক্ত হবেন। সে চেষ্টা করলেন না। কচ্ছপের মতো খোলেই ঢুকে রইলেন। দরজায় দরজায় গোটাচাকের কোলাপসিবল গেট। লাগিয়ে ফেললেন। বড় বড় তালা। বাইরে থেকে কেউ ঢুকতে চাইলে কেলেঙ্কারি কাণ্ড। তিন দরজা, তিন গেট, তিন তালা খুলে, আবার লাগাতে লাগাতে ফিরে যাওয়া। বাড়িটা যেন ব্যাঙ্কের লকার। পরিবারবর্গের সেফ ডিপজিট ভল্টে বসবাস। সবাই সিদ্ধান্ত করলেন, মানুষটার চোরফোবিয়া আছে। জগতটা চোরে থিকথিক করছে, এইরকমই হয়তো ভবেন।
আমার বেলুড় মঠে একবার নতুন জুতো চুরি হয়ে গিয়েছিল সেই ছাত্রজীবনে। সেই থেকে কেবলই মনে হয়, জুতো খুললেই চুরি হয়ে যাবে। কোনো ধর্মস্থানে গেলে জুতো খুলেই একটা কাঁধ ঝোলা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিশ্চিন্ত হই। ধর্মস্থানে একদল পরোপকারী মানুষ অবশ্যই থাকরেন। তাঁদের ব্রত হল, মানুষকে ত্যাগ শেখান। খালিপদ না হলে কালীপদ লাভ করা যায় না। এত সাবধান হওয়া সত্ত্বেও আরও দুবার আমার জুতো চুরি হয়েছিল। দুবারই ট্রেনে। চালাকের চেয়েও চালাক থাকে। দাদারও দাদা।
দূরপাল্লার যাত্রী। একেবারে আপারবাঙ্কে জুতসই। শুধু নই, জুতো সই। ফু বালিশের পাশে দুপাট শায়িত। জোড়া স্ত্রীর সঙ্গে যেন ফুলশয্যা! তার আগে বাথরুম ঘুরিয়ে এনেছি। ঘেন্না ঘেন্না করছিল। সংস্কারকে শাস্ত্ৰবাক্য শোনালুম-আতুরে নিয়মনাস্তি। কোলের ওপর কাগজ ফেলে শুকতলা মার্কা লুচি আর শুকনো আলুর দাম দিয়ে ডিনার শেষ করে, আগাথা কিস্টি নিয়ে শুয়ে পড়লুম। ট্রেন জোর ছুটিছে টাল খেতে খেতে। সন্ধানী চোখে সরেজমিন করে সন্দেহজনক ছিচকে টাইপের কোনো যাত্রী খুঁজে পেলুম না। নাকের ডগায় রেলগাড়ির ছাত। ডানপাশে ঝুলকালো পাখা। ‘লফটে তুলে রাখা ট্র্যাঙ্কের মতো লাগছিল আমার।
হারকিউল পয়েরোর কীর্তিকাহিনী পড়তে পড়তে নিদ্রা গেলুম। ভোরে ঘুম ভাঙল। ভুলও ভাঙল। জুতো জোড়া হাওয়া। হরিদ্বারে ট্রেন থেকে নগ্নপদে অবতরণ। লোকে হোটেলে যায়, আমি গেলুম জুতোর দোকানে। শিক্ষাটা হল। জুতো যেন জীবন। যখন যাবার তখন যাবেই। কারো বাপের ক্ষমতা নেই ধরে রাখে।
এর পরের বারে আরো একটু বুদ্ধিমান হয়ে, চোদ্দ ফুটো জুতোর ফিতে বেঁধে শুয়ে পড়লুম। সেই অপার বার্থ। চোদ্দ ফুটো মানে নয়া জমানার জুতো। খুলতে পরতে পা ঢোকাতে পাক্কা আধঘণ্টা। বুদ্ধি করে মাথাটাকে ফেলেছি প্যাসেঞ্জার দিকে আর পা দুটো জানলার দিকে। ট্রেন চলেছে। সিডনি শেলডন পড়ছি। মাথার সামনে দিয়ে লোক যাচ্ছে আসছে। কত রকমের ক্যারিকেচার। ট্রেন মানেই শক, তুন দল, পাঠান, মোগল, এক দেহে হল। লীন। কেউ খায়, মুডুকু তো কেউ বাটাটা পুরি। কেউ পূব বঙাইল বলে তো কেউ ইল্লে কুঁড়। মাঝ ব্যাঙ্কে সটান ছফুট সর্দারাজি লোয়ার বার্থে ফ্ল্যাট সাড়ে ছফুট সর্দারনীকে তাল ঠুকছে আরে তোড় দেন। ট্রেনের দৃকপাত নেই। দমকল, বোমকল করতে করতে স্টেশানে ঠেক খেতে খেতে চলছে তো চলছেই। সাড়ে সাত পকেট অলা টিটির কষে ব্যবসা করছে। গবা মার্কা লোকদের উৎপাটিত করে হাওলামার্কাদের সুখশয্যার ব্যবস্থা। পকেট পুরুষ্ট হচ্ছে। আহা! ওদের ছেলেরা যেন থাকে দুদে ভাতে। বোতল বোতল যেন পড়ে মোর পেটে। পেট নয় তো ধামা ওদিকে বন্দুকধারী মামা। রাত যত বাড়ে পাপ ও তত বাড়ে।
সকালে উঠে দেখি রাত ফর্সা, পায়ের জুতো জোড়াও ফর্সা।
আমার সহযাত্রী ছিলেন একালের এক বিখ্যাত গায়ক। অফুরন্ত পুরাতনী গানের বিস্ময়কর ভাণ্ডারী। এক ডাকে চিনবেন সবাই। দিলদার রসিকজন ৷ প্ৰকৃত এক বাঙালি। তিনি গান ধরলেন, আর ঘুমাও না মন। মায়া-ঘোরে কতদিন রবে অচেতন।| কে তুমি কি হেতু এলে, আপনারে ভুলে গেলে, চাহরে নয়ন মেলে, ত্যাগ কুস্বপন। রয়েছে অনিত্য ধ্যানে। নিত্যানন্দ হের প্রাণে তম পরিহরি হের তরুণ-তপন। জুতোর শোক ভুলে প্রকৃতই তরুণ-তপন হেরিলাম। পুব আকাশে। পাহাড়ের মাথায়। একটা নীল জঙ্গল উলটো দিকে পালাচ্ছে। ট্রেনের ভ্ৰমণ-ক্লান্ত, রাতিজাগা মানুষগুলোকে মনে হচ্ছে বাসী আলুর দম। চোর, সাধু, উদার, কৃতদার, বৃকোদর সবাই সেই উদ্ভাসিত আলোয় গতিতে গতিহীন। শুয়ে বসে ছুটছে।
সাত্ত্বিক চেহারার এক প্ৰবীণা পাশের খাঁচা থেকে পাগলপারা হয়ে ছুটে এলেন। আবেগ চাপিতে পারছেন না। ঠেলোঁঠুলে বসে পড়ে বললেন, ‘গোপাল আমার, এতদিন কোন বৃন্দাবনে লুকিয়ে ছিলে?’ হেভিওয়েট বক্সারের মতো হেভিওয়েট গোপাল। গোপালের অবশ্য অনেক রূপ, নাড়গোপাল থেকে বুড়োগোপাল। প্ৰবীণা পরম বৈষ্ণব। ফার্স গলায় গোটা গোটা তুলসীর মালা। শরীরের লালিত্য দেখলেই মনে হয় স্রেফ মালপো, ক্ষীরপো আর পুস্প্যান্নের ওপর আছেন। মনে হয় বৃন্দাবনেই চলেছেন।