এমন সময় কোথা হইতে এক দুষ্ট ব্যাধ আসিয়া পাখি দুটির পানে তীর ছুঁড়িয়া মারিল। এমন সুখে পাখী দুটি খেলা করিতেছিল, তাহাদের কোনো দোষ ছিল না,কোনো বিপদের কথা তাহারা জানিত না। এমন নিরীহ জীবকে বধ করে, এমন নিষ্ঠুরও লোক হয়? তীর খাইয়া পুরুষ পাখিটি যাতনায় ছট্ফট্ করিতে লাগিল, মেয়েটি শোকে আর ভয়ে কাঁদিয়া আকুল হইল। মুনি আর এ দুঃখ সহিতে না পারিয়া ব্যাধকে বলিলেন, “ওরে ব্যাধ, এমন সুখে পাখিটি খেলা করিতেছিল, তাহাকে তুই বধ করিলি? তোর কখনই ভালো হইবে না!”
দয়ালু মুনির মনের দুঃখ তাঁহার চোখের জলের সঙ্গে সঙ্গে এই কথাগুলির ভিতর দিয়া ফুটিয়া বাহির হইল।
সেই কথায় আপনা হইতেই ছন্দ আসিয়া আপনা হইতেই তাহা কবিতা হইয়া গেল। সেই কবিতাই সকলের প্রথম কবিতা, তাহার পূর্বে কেহ কবিতা রচনা করে নাই।
মুনি আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, “এ কি চমৎকার কথা আমি বলিলাম! আমি কিছুই জানি না, তবু ইহাতে বীণার ছন্দের মতন কেমন সুন্দর ছন্দ হইল! ইহার চারিভাগে সমান সমান অক্ষর হইল! আমি বলি, ইহার নাম ‘শ্লোক’ হউক, কেননা আমার শোকের সময় ইহা আমার মুখ দিয়া বাহির হইয়াছে।”
ভরদ্বাজও বলিলেন, ‘গুরুদেব! কি সুন্দর কথা, এমন কথা তো আর কেহ কখনো বলে নাই। ইহার নাম শ্লোকই হউক।”
তারপর মুনি স্নান শেষে ঘরে আসিয়া সেই পাখির আর সেই সুন্দর ছন্দের কথা ভাবিতেছেন, এমন সময় ব্রহ্মা আসিয়া সেখানে উপস্থিত হইলেন, পাখি দুইটির দুঃখে কাতর হইয়া মুনি আর ব্রহ্মাকে অন্য কথা বলিবার অবসর পাইলেন না, তাঁহাকে সেই দুষ্ট ব্যাধের কথা বলিয়া সেই কবিতাটি গাহিয়া শুনাইলেন।
তাহা শুনিয়া ব্রহ্মা বলিলেন, “বাল্মীকি, তোমার এ কবিতার নাম শ্লোকই হউক। এইরূপ শ্লোক লিখিয়া তুমি রামের বৃত্তান্ত বর্ণনা কর। সে বড় সুন্দর কাহিনী, তাহা যে পড়িবে, তাহারই মঙ্গল হইবে। তুমি যাহা লিখিবে, তাহার একটি কথাও মিথ্যা হইবে না। যতদিন পৃথিবীতে পর্বত আর নদী সকল থাকিবে, ততদিন লোকে তোমার ‘রামায়ণে’র আদর করিবে। আর ততদিন রামায়ণের আদর থাকিবে, তুমি স্বর্গে গিয়া ততদিন আমার লোকে থাকিতে পাইবে।”
এই বলিয়া ব্রহ্ম চলিয়া গেলেন, আর তাঁহার কথাগুলি মনে করিয়া বাল্মীকি বলিলেন, “এইরূপ মিষ্ট শ্লোক দিয়া আমি রামায়ণ রচনা করিব।”
তারপর সেই ধার্মিক কুশাসনে বসিয়া জোড়হাতে ভগবানকে স্মরণপূর্বক রামায়ণ লিখিতে আরম্ভ করিলেন। ক্রমে রামায়ণ শেষ হইল। তখন মুনি ভাবিলেন, ‘কাব্য তো শেষ হইল, এখন ইহা গাহিবে কে? ঠিক সেই সময়ে ‘কুশী’ ‘লব’ দুই ভাই আসিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিলেন। দুটি ভাই রামেরই পুত্র, মুনির বেশে সেই আশ্রমে থাকিয়া লেখাপড়া শিখেন। দেবতার মতন সুন্দর, গন্ধর্বের মত মিষ্ট গান গাহেন। মুনি বলিলেন, “এই আমার রামায়েণের উপযুক্ত গায়ক।”
সেই দুটি ভাইকে পরম যত্নের সহিত মুনি রামায়ণ শিক্ষা দিলেন। তারপর একদিন সকল মুনিদিগকে সভায় ডাকিয়া সেই রামায়ণের গান তাঁহাদিগকে শোনানো হইল। মুনিরা সকেল মোহিত হইয়া সে গান শুনিলেন, তাঁহাদের চোখ দিয়া দরদর ধারে জল পড়িতে লাগিল, আর মুখ দিয়া ক্রমাগত কেবল “আহা!” “আহা!” এই শব্দ বাহির হইতে লাগিল। শেষে তাঁহারা আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। একজন মুনি তাঁহার নিকটে যাহা কিছু ছিল, সকলই কুশী-লবকে দিয়া দিলেন। অন্যেরা কেহ বল্কল, কেহ হরিণের ছাল, কেহ কমণ্ডলু, কেহ কুড়াল, কেহ কৌপীন দিলেন। একজন মুনি কাঠ আনিতে চাহিয়াছিলেন, সেই কাঠ বাঁধিবার দড়িগাছি ভিন্ন তাঁহার নিকটে আর কিছু ছিল না, তিনি সেই দড়িগাছিই কুশীলবকে দিয়া বারবার আশীর্বাদ করিলেন।