কিন্তু নিষ্ঠুর রসিক বিধাতার আবার কৌতুক। আবার স্বপ্নে উদিত হলো সেই অতীরে দৃশ্যগুলো সিনেমার মতো।
…জানলার কাছে দাঁড়িয়ে জয়ন্ত। আজ হঠাৎ অফিস থেকে এত তাড়াতাড়ি প্রত্যাবর্ন।
সামনের মুদির দোকান থেকে টুকটাক কয়েকটা রান্নার জিনিষ কিনে ঘরে ঢুকেই জয়ন্তকে দেখে অবাক জয়িতা।
-কি ব্যাপার, আজ এত—
মুখ ফেরায় জয়ন্ত। অতি বিষণ্ণ মুখ।
খুব বিপদে পড়ে গেছি, জয়ি—
–কি হয়েছে?
কোনমতে জিনিষগুলো রেখে প্রায় ছুটে আসে জয়িতা।
জয়ন্ত বলে বিয়ের সময় আগরওয়ালার কাছ থেকে বেশ কিছু টাকা নিয়েছিলাম। তারপর নানা ঝাটে, দেখতেই পেয়েছ—তোমার অসুখ গেল, বাবা। মারা গেলেন, একটার পর একটা….তাই কিছুই শোধ দেওয়া যায়নি।
চুপ করে যায় জয়ন্ত। জয়িতা অস্থির।
—কিন্তু বিপদটা কি হলো?
আবার মুখ খোলে জয়ন্ত-সুদে-আসলে অঙ্কটা বেশ বড়ই দাঁড়িয়ে গেছে …আজ অফিসে এসে সকলের সামনে বিশ্রিভাবে শাসিয়ে গেল—তিনদিনের মধ্যে
–পুরো টাকা শোধ দিতে হবে।
–কত টাকা?
—তা প্রায় হাজার পাঁচেক হবে।
—পাঁচ হাজার!–এবার জয়িতাও চিন্তিত, বিষণ্ণ।
জয়ন্ত মৃদু কনসেশন শোনায়—আপাতত, পুরোটা না পারলেও, মানে অল্প কিছু দিলেও কদিন ঠেকিয়ে রাখা যাবে।
—অল্প কিছু? কত?
–ধরো, এই হাজার দেড়-দুই—
কিছুক্ষণ কি যেন ভাবে জয়িতা। তারপর নিজের হাতের দু-গাছা চুড়ি, আর কানের দুল দুটো দ্রুত খুলে ফেলে।
—আপাতত এটা ধরো—ম্লান হাসি জয়িতার মুখে।
জয়ন্ত চমকে ওঠে–না না,এটা সম্ভব নয়—
—কেন নয়? এখন মানটা বাঁচাও, তারপর আবার সময়মতো করে দেবে।
না জয়ি, এ পর্যন্ত আমি তোমাকে নিজে থেকে কিছুই দিতে পারিনি। আর এখন, ….তার উপর তোমার বাবা-মা যেটুকু দিয়েছিলেন—আজ যদি তারা বেঁচে থাকতেন কি বলতেন–
–বলতেন—বেশ করেছিস, সংসারের প্রয়োজনেই তো এগুলো দেওয়া। পটের বিবি সেজে থাকার জন্য নয়–
জয়ন্ত স্থবির।
–নাও, ধরো, তুমি তো পরে আবার বানিয়ে দেবে।
–জানি না।…এই তো রোজগার। ধরো, যদি কোনদিনই দিতে না পারি?
–নাই বা পারলে।–এবার জয়িতার মুখে কেমন একটা বিজয়িনীর হাসি।
জয়স্তর গলা দুহাতে জড়ায় জয়িতা, বুকে মাথা রাখে—আমার আসল অলংকার তো এইখানে।
ঠিক এক সময়ে কে যেন উঁচু গলায় চিৎকার করে—কাট্।
ক্যামেরা, আলোর কাজ থেমে যায়।
কোন সুটিং চলছিল?
কে যেন অন্ধকার কোন থেকে বলে ওঠে—একেবারে ভিজে প্যাঁচপ্যাচে সেকেলে রোমান্স হয়ে গেল ডিরেক্টর সাহেব। দর্শক এই বই নেবে কি! নাচ গান ডেয়ারিং প্রেসের দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত দর্শকেরা হল ছেড়ে চলে যাবে।
ঘুম ভেঙ্গে যায় জয়িতার।
ইস, আবার সেই দুঃস্বপ্ন।
ঘড়িতে চারটে। এখুনি উঠতে হবে যে—বু উঠতে পারে না জয়িতা। কাল রাতে আর আজ দুপুরের স্বপ্নগুলো তো আসলে স্বপ্ন নয়। ওতো এই জীবনেই ঘটেছিল, গত জন্মে নয়। এই হাত দুটোই তো জড়িয়েছিল জয়ন্তের গলা। আজ সেই হাত দুটো কার গলা জড়াবে। এই মাথাটা স্থান পেয়েছিল জয়ন্ত্রে বুকে আজ
কেমন স্লথ, অলস, প্যারালেটিকাল একটা অবস্থা ছেয়ে ফেলে জয়িতার দেহমন। শয্যা ছেড়ে ওঠার শক্তি যেন হারিয়ে ফেলছে জয়িতা।
হঠাৎ বুকটা কেঁপে ওঠে। দুপুরে থানা থেকে একটা ফোন এসেছিল না? কি যেন বলল পুলিশ? এখন মনে হচ্ছে—ওই ফোনটা ঠিক আর দশটা উটকো ভুতুড়ে ফোনের মতো নয়। রীতিমত সিরিয়াস কোন সতর্কবাণী। কিন্তু কেন?
জয়ন্ত এখন কোথায়? বাড়িতে নেই—সেটা বোঝা যাচ্ছে। কারখানায়, রয়েছে কি এখনও? আর দশটা দিনের মত কাজ করে যাচ্ছে? সাড়ে পাঁচটায় ছুটি। বাড়ি আসতে আসতে প্রায় সাড়ে ছ’টা। তখন ফিরে জয়িতাকে তো আর দেখতে পাবে না জয়ন্ত। জয়িতা তখন অনেক দূরে একযুগ দূরে, অতীতের কেউ, একটা ছায়া বা একটা স্মৃতি। অথবা একটা কল্পনা মাত্র।
ভাবতে ভাবতে আরও নিথর হয়ে যায় জয়িতা। আঃ, জয়ন্ত আজও আসতে এত দেরি করবে। আর, আরো আশ্চর্য লোকটা তো একবারও এক মুহূর্তের জন্যেও বলল না—যেও না। কেন?
বাধা না পেলে ছেড়ে যাওয়ার মধ্যে কোন মজা নেই। খেলায় ওয়াক-ওভার পেয়ে যেমন কোন আনন্দ হয় না।
কানের কাছে বারবার বাজছে একটা গানের সুর—
মোরা গরীব হতে পারি–
(তা বলে) সুখের সাথে নয়কো আড়ি–
(তাই) মুখ করো না হাঁড়ি–
কে যেন বলছে—আমার আসল অলংকার তো–
ভিজে প্যাঁচপ্যাচে রোমান্স। খুব ভালো। বলার মধ্যে কিন্তু কোন ফাঁকি ছিল না। চোখের জলে জয়ন্তের পাঞ্জাবি ভিজেছিল—হয়তো বা এতই কেঁদেছিল জয়িতা যে জয় জামা প্যাঁচপ্যাচে হয়েই ভিজে গিয়েছিল। আজকের দিনের যাত্রার দৃশ্যের মতো। মেলোড্রামা। কিন্তু একবিন্দু কৃত্রিম কিছু ছিল না এই মেলোড্রামার মধ্যে।
আবার কেমন একটা ঘুম আসছে।
লড়াই করে বু একবার উঠবার চেষ্টা করল জয়িতা। কিন্তু বৃথা। মুখের কাছে একটা মুখ, সেইরকম হাসছে সুখের সাথে নয়কো আড়ি-মুখ করো না হাঁড়ি।
দুই হাতে সেই মুখটাকে কাছে টানতে চেষ্টা করল জয়িতা। কিন্তু ফাঁকা শূন্যে এলোমেলো ঘুরে ফিরে এলো হাতটা? আঃ সেই রক্ত মাংসের, শান্ত সৌম্য, দুষ্টমিষ্টি চোখের, চাপা হাসির মুখটা কই? কোথায়?
আবার সেই পরম ক্লান্তি এবং সেই প্রগাঢ় ঘুমের ঢেউ। ঘুমিয়ে পড়ল জয়িতা।
এবং টেরও পেল না কখন সাড়ে ছটা পেরিয়ে গেছে।