—আচ্ছা রুবি, আজকের ব্যাপারটা সত্যি উচিত হচ্ছে তো? তুমি তো সবই জান! নিশ্চয় এতদিনে এটাও বুঝতে পার—সারাজীবন আমি অদ্ভুত এক রাশিচক্রের তাড়নায় একা রয়ে গেছি। হয়তো বাকি জীবনটাও সেভাবেই কেটে যেত। কিন্তু হঠাৎ….
রুবি বাধা দেয়—ওসব চিন্তা ছাড়ুন স্যার। এত বড় কোম্পানির মালিক আপনি, হাজার লোকের সংসার আপনার মুখ চেয়ে থাকে, সবাই আপনাকে শ্রদ্ধা করে—
—কিন্তু কাল থেকে যদি তারা অন্য দৃষ্টিতে দেখতে থাকে? অশ্রদ্ধা আসে? অবকোর্স, আই ডোন্ট কেয়ার—তবু সবাই কি আমাকেই দায়ী করবে না? সবাই কি বলবে না—টাকা আর প্রতিপত্তির জোরে আমি আমার এক নির্দোষ নিরীহ কর্মচারীর ঘর ভেঙ্গে দিলাম?
—মোটেই না। জয়িতাদেবী তো ছেলেমানুষ নন। তিনি স্বেচ্ছায় আপনার কাছে আসছেন। আপনি তাকে ফিরিয়ে দেবেন কেন? জয়বাবুর ক্ষমতা থাকলে ওকে আটকে রাখুক। আপনি তো কোন জোর করছেন না।
ধীরে ধীরে মেঘ কাটে। শ্ৰীমরে মনের মেঘ। হা রুবি তো যুক্তিসঙ্গত কথাই বলছে।
আবার হাসেন শ্ৰীমন্ত-এবার তোমার কথা বলো। তোমার আর কিরণের বিয়ে কবে হচ্ছে?
লজ্জা পাওয়ার মেয়ে না হয়েও একটু লজ্জা পায় রুবি।
—তার জন্য তাড়া কিসের?
—দেরিও বা কিরে? সারা জীবন শুধু প্রেম করেই কাটিয়ে দেবে? আমরা নেমন্তন্ন খেতে পাব না।
কথা ঘোরায় রুবি স্যার ঘড়ি দেখুন, টাইম পেরিয়ে যাচ্ছে।
ঘড়ি দেখে চমকে ওঠেন শ্ৰীমন্ত। সত্যিই তো অনেকটা সময় কেটে গেছে। বলেন—অল রাইট, ইউ দেন গেট রেডি।
আমি তো রেডি বলে ওভারঅল লাল-বিকিনি পরা মোমের পুতুল হয়ে যায় রুবি। মাথায় ক্যাপটা লাগাতে লাগাতে ডাইভিং বোর্ডের দিকে এগোয়।
–আমি এগোচ্ছি, আপনি আসুন।
ঝপাং।
রুবির ডাইভের জলশব্দ শোনা যায়। ড্রেসিং গাউন খুলে মানের পোষাকে সাঁতারের জন্য প্রস্তুত হন শ্ৰীমন্ত। এবং ঠিক সেই সময়েই কোনায় রাখা টেলিফোন বেজে ওঠে।
ক্রিং ক্রিং! ক্রিং ক্রিং!
আবার ড্রেসিং গাউন জড়িয়ে টেলিফোন ধরেন শ্ৰীমন্ত।
হ্যালো। ওপারে পুলিশ অফিসারের বরফ শীতল গলা—
—আমি এস. পি. বলছি। সন্ধেবেলা বাড়িতে থাকবেন। আনফরচুনেটলি, আমাদের ডিউটি আমাদের করতে হবে। ইনকাম ট্যাক্স, বৈদেশিক মুদ্রা আইন ইত্যাদি আরও কয়েকটি ইকোনমিক অফেন্সের জন্য আপনাকে গ্রেপ্তার করতে হচ্ছে। বাড়িতে ফোন করে জানলাম—আজ আপনাদের একটা সামাজিক ঘরোয়া অনুষ্ঠান আছে তাই। আমরা একটু রাত করেই যাব। সাপোেজ, অ্যারাউন্ড ও ইলেভেন—ততক্ষণে নিশ্চয়….
খবরের ধাক্কাটা সামলাতে একটু সময় লাগল শ্ৰীমন্তর। তভু যথাসম্ভব উত্তেজনা চেপে শান্ত স্বরে বললেন—আসবেন।
.
সন্ধে সাড়ে ছটায় শ্রীমন্তর গাড়ি আসবে। এখন দুপুর একটা। দেড় ঘণ্টা আগে—অর্থাৎ সাড়ে এগারটায় শ্রীমন্তর ফোন এসেছিল। তার মানেজয়িতার চিঠি বাড়ির পিওন মারফত শ্ৰীমন্তর হাতে পৌঁছে গিয়েছিল এগারোটা নাগাদ। ডেডলাইন ওভার হবার একঘণ্টা আগে।
–এখন ফোনে কিছু বলতে পারছি না। অফিসের চেয়ারে বসে ভয় করছে—যদি আমার উচ্ছাস বাঁধ ভেঙ্গে সব ডেকোরাম ভুলিয়ে দেয় তাই একটু পরেই বেরিয়ে যাচ্ছি। ক্লাবে স্নান-খাওয়া সেরে বাড়ি চলে যাব। খুবই লিমিটেড কয়েকজন উপস্থিত থাকবে। রুবি থাকবে তোমার পরিচৰ্য্যায়। ও-ও ভীষণ খুশি—একটা কথাই শুধু এখন বলছি। মনে হচ্ছে সন্ধেটা আসতে যেন একযুগ দেরি করছে।
—আমারও তাই মনে হচ্ছে।
–ফুলের সাজ! মনে আছে?
—আছে।
—গাড়ি ঠিক সাড়ে ছটায়।
—ঠিক আছে।
—তোমরা আসতে যেন সাতটা-এক না হয়।
–সাতটা বাজতে এক হতে পারে তো?
টেলিফোনের ওপারে হেসেছিল শ্ৰীমন্ত–হ্যাঁ, তা হতে পারে। মোট কথা, ইউ ওন্ট বি লেট বাই ইভেন ওয়ান মিনিট।
–যদি হয়—
—দেখবে আমি নেই!
–তার মানে?
—মানে, আমি উর্ধলোকে—
—ছিঃ,—মিষ্টি ধমক সুরেলা হয়ে উঠেছিল জয়িতার গলায়–আর দ্বিতীয়বার এমন কথা বলবে না।
…তাই এখন বেশ পাশবালিশটা জড়িয়ে শ্ৰীমন্তর ফটোটা আরেকবার মুগ্ধ হয়ে দেখছিল জয়িতা। এর আগে বোধহয় একলক্ষ বার দেখেছে। এরপর এই ফটোর মানুষটাই ফটোটা এখন যেখানে রয়েছে—একদম বুকের ওপর—সেইখানে চলে আসবে।
এই মানুষটা জয়িতাকে পুনর্জন্ম দিল বলা যায়।
বিকেল থেকেই শ্ৰীমন্ত জয়িতার আওয়স-কি-আওয়াজের জন্য কান পেতে থাকবে।
সত্যিই, সন্ধেটা আসতে যেন এক যুগ দেরি।
এবং শ্ৰীমন্তর ছবিটা বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল জয়িতা। সব কিছু—অর্থাৎ এখন যেসব জিনিষপত্রগুলো নিয়ে যাবে—তৈরি আছে। চারটের মধ্যে উঠে পড়ে সাজসজ্জা রূপচর্চা। অপরূপা জয়ি যখন সর্বজয়ী রাজকন্যার মতো ঝলমল করে উঠবে—তখনই হয়তো শোনা যাবে শ্ৰীমন্ত গাড়ির হর্ন।
কিন্তু আশ্চর্য, বিধান কি বেরসিক—ঘুমের আগেই একটা দুর্বোধ্য টেলিফোন এলো-থানা থেকে বলছি। আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছি—শ্ৰীমন্ত মুখার্জীর বাড়িতে সন্ধেবেলা আপনার যাওয়া উচিত হবে না।
চমকিত উত্তেজনায় কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ফোনটা রেখে দেওয়া হলো ওদিক থেকে।
নিজেকে সামলে নিল জয়িতা। অতীতেও এই ধরনের বহু উটকো টেলিফোন এসেছে অশ্লীল, অশালীন, ভীতি প্রদর্শন, শ্রীমম্ভর নামে কুৎসিত অপবাদ। শ্ৰীমন্ত বলেছিল—অল কুলপিট? ইগনোর দেম। এসব তুচ্ছ ব্যাপার আমাদের সুখ-শান্তি নষ্ট করার ক্ষমতা রাখে না।
শ্ৰীমন্তর সেই ব্যক্তিত্বপূর্ণ অভয়বাণীগুলো স্মরণ করে ঘুমিয়ে পড়েছিল জয়িতা।