—ম্যানেজ করতে হবে।
বেরিয়ে যাবার জন্য তৈরি হয় জয়ন্ত।
জয়িতা খুশিই, ম্যানেজ মাস্টার।
তারপরেই ভীষণ গম্ভীর মুখ
—আমি যাব না।
—সে কি, আবার হাঁড়িমুখ করার কি হলো।
হঠাৎ জয়িতার মনের কিছু জমাট ক্ষোভ কথার বাম্প হয়ে বেরিয়ে আসে—মাসের শেষ। দুধের টাকা বাকি। রেশন আনা হয়নি।
জানলা দিয়ে বাইরে তাকায় জয়িতা। অর্থাৎ জয়ন্ত্রে কাছে মুখের ভাব গোপন করতে চায়।
–বাড়িওয়ালার বৌ কাল খোঁটা দিয়ে গেছে। হুঃ, এই সময় সিনেমা।
জয়ন্ত বিরক্ত—এই একঘেয়ে, কথাগুলো আর ভালো লাগে না।
ঘুরে জয় মুখোমুখি হয় জয়িতা। চোখের কোণায় জল—কিন্তু কথাগুলো কি মিথ্যে?
এগিয়ে আসে জয়ন্ত। জয়িতার দুকাঁধে হাত রেখে বলে—তাই বলে কি সব সময়, সমস্ত মুহূর্তে শুধু অভাবের ব্যাপারগুলোকে পুজো করতে হবে?
জয়িতার চিবুকে আঙুল ঠেকিয়ে মুখটা তুলে ধরে জয়ন্ত। চুমুর মুডটা তৈরি হয়নি এখনও।
—আরে বাবা, গরীরেও যেটুকু সাধ-আহলাদ থাকে, সেটা আপনা থেকে পূরণ হয় না। বেশ খানিকটা চেষ্টা করে মেটাতে হয়। রাতদিন খালি গেলাম, মরলাম, এটা নেই, সেটা নেই, কাল কি হবে—এই ভাবতে থাকলে জীবনটা যে বরবাদ হয়ে যাবে।
জয়িতার রাগ কমে এলেও, রেশটুকু রয়েছে।
-হ্যাঁ, তাই চারদিকে খোঁচাসানটা-তাগাদা খেয়েও সেজেগুঁজে লোক হাসিয়ে সিনেমা যাওয়া চাই।
জয়ন্ত হাসে–চাই-ই তো। গরীব বড়লোক যাই বল, প্রত্যেক মানুষের সুখী হবর অধিকার আছে।
আরও জোরে হাসতে থাকে এবং তারপরেই জয়িতাকে বুকের মধ্যে সজোরে চেপে ধরে। যেন হারিয়ে যাবে জয়িতা। জয়িতা ঠোঁটের উপর আলতো কামড় দেয় জয়ন্ত। জয়িতার ‘উঃ শুনে বলে—আগে বলো—ঠিক বলেছি কিনা, নইলে কিন্তু আরও জোরে!
মুক্তি পাবার জন্যই হোক, অথবা স্বামী সোহাগে মানসিক বিবর্তনে হোক, জয়িতা বলে—ঠিক বলেছ।
এইবার ঘর ছেড়ে রেবার আগে গান ধরে জয়ন্ত–
—মোরা গরীব হতে পারি,
(তা বলে) সুখের সাথে নয়তো আড়ি–
(তাই) মুখ কোর না হাঁড়ি।
শেষ দৃশ্য :
জয়ন্ত রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে কারখানার দিকে যাচ্ছে। জানলা দিয়ে হাত নাড়ে জয়িতা। একটু জোরে বলে—তাড়াতাড়ি ফিরো–
জয়ন্ত সম্মতিসূচক হাত নাড়ে। দূরে মিলিয়ে যায় সাইকেল।…
ঝনঝন করে কি যেন ভাঙল কোথাও। মনে হয় কাঁচের কোন জিনিস।
ঘুম ভেঙে যায় জয়িতার, আজকের জয়িতার। দুগ্ধফেনিল শয্যায়। চমকে উঠে বসে। জানলার ওপারে আকাশ সাদাটে-ঘোলাটে হয়ে এসেছে।
.
সরেই জুনের সকাল।
জন্মদিনেও কাজের কামাই দেন না শ্ৰীমন্ত মুখার্জী। তবে তার পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট সুন্দরী, আধুনিকা রুবি রায় বিশেষ ব্যস্ত ছিল টেলিফোনে শেষ পর্বের কিছু জরুরি কাজ সারতে। বোঝা গেল, আজকের সন্ধের ‘বসে’র বার্থ-ডে পার্টিতে কবি রায়কে থাকতে হবে। এতদিন বাদে এমন একটা নাটকীয় কাণ্ড হতে চলেছে—শ্ৰীমন্ত মুখার্জী বিয়ে করছেন, বা অফিসিয়ালি সংসারী হওয়ার অঙ্গীকার নিচ্ছেন। সেখানে তার চিরবিশ্বস্ত সহযোগী রুবি রায় না থাকলে চলবে কি করে?
কিন্তু আজ বেশিক্ষণ অফিসে থাকবেন না শ্ৰীমন্ত মুখার্জী। কারণ যে যে এনগেজমেন্ট ও রুটিন প্রোগ্রামগুলো আছে, সেগুলো ঘড়ি ধরে সারতে হবে।
তাই বেলা সাড়ে বারোটার সময় শ্ৰীমন্ত মুখার্জী ও রুবি রায়কে দেখা গেল সাবার্বান সুইমিং ক্লাবে, যেখানে নারীপুরুষের একসাথে জলবিহারে কোন বাধা নেই। সানগ্লাস চোখে ড্রেসিং গাউন জড়িয়ে বেতে চেয়ারে বসে ম্যাগাজিনে চোখ বুলোতে বুলোতে কখন এক বোতল বিয়ার প্রায় শেষ করে এনেছেন শ্ৰীমন্ত মুখার্জী, তখনই লেডিজ ক্লোকরুম থেকে আবির্ভূতা হলো রুবি। তার পাতাল সাদা ওভার-অলের নীচে টকটকে লাল বিকিনি-টু-পিস সুইমিং কম—শ্ৰীমন্ত মুখার্জীর নির্লিপ্ত কালো চশমার ওপর হঠাৎ আলোর ঝলকানি হানল।
চোখ থেকে সানগ্লাস সরিয়ে, ম্যাগাজিনটা হেলায় ছুঁড়ে ফেলে হাসলেন শ্ৰীমন্ত। ছুটে এসে পেছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরল রুবি। তারপর পাশের চেয়ারটায় বসল।
—আপনাকে আজ রিয়েলি দারুণ চার্মিং লাগছে স্যার রুবি উচ্ছ্বসিত।
হাসলেন শ্ৰীমন্ত রুবি, আজ আমি উনপঞ্চাশে পা দেব। বয়সটা তো শিগগিরই হাফ-সেঞ্চুরি করে ফেলবে। দশ বছর আগে এসব কথায় দারুণ ফ্ল্যাটার্ড হতাম কিন্তু এখন আর–
রুবি মাথা ঝাঁকায়—ফ্ল্যাটারি নয় স্যার, বিশ্বাস করুন, ইউ আর লুকিং ভেরি মাচ হ্যান্ডসাম। বয়স আপনার মাথার চুলে কিছু ছাপ রাখলেও শরীরের আর কোন
জায়গা ছুঁতে পারেনি। বহু ইয়ং ছেলে আপনাকে হিংসে করবে।
শ্ৰীমন্ত আবার হাসে–আঃ রুবি, তুমি এ মাসেই আবার একটা ইনক্রিমেন্ট আদায় করে ছাড়বে!
রুবি মোটেই ঘাবড়াবার পাত্রী নয়—এবার কিন্তু স্যার আমি সত্যিই রাগ করব। আপনার বিজনেসম্যান আত্মাটা কোন সময়েই আপনার মাথা থেকে নামে না। তাই সব কথাতেই মোটিভ ধরে বসেন। আজকে আপনার এবড় একটা শুভদিনে আমি কেন মিথ্যে বলব বলুন তো?
শুভ দিন!
হ্যাঁ, সত্যিই শুভদিন। আজ বেলা এগারটার মধ্যেই চিঠি এসে গেছে অনেক ভেবে মনস্থির করে ফেলেছি। তোমরা দু-চোখের অতল গভীর দৃষ্টির আহ্বানকে ফিরিয়ে দেবার শক্তি আমার নেই..কথা দিলাম—আমি আসছি, তোমার কাছে, চিরদিনের জন্য…। এখন একমাত্র তোমার—জয়িতা।
হঠাৎ কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যান শ্ৰীমন্ত।