—তোমার কিছু বলার আছে?
–না।
—কেন নেই?—হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে কেমন বোকার মতো প্রশ্ন করে ওঠে জয়িতা। অবার এই প্রশ্ন—যার উত্তরের কোন প্রয়োজন নেই। বু মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে কথাটা।
—তোমার যেটা যোগ্য, উপযুক্ত স্থান, সেখানেই তুমি যাচ্ছ। আমি তো তোমায় তোমার উচিত জায়গা দিতে পারিনি।
-সেটা বুঝতে পেরেছ?
–বুঝেছি বলেই তো বললাম।
–কবে থেকে বুঝেছ?
-যেদিন শ্ৰীমন্ত মুখার্জী প্রথম আমাদের সেই পুরনো বাড়িতে এলেন। সেদিন থেকে। প্রায় বছরখানেক আগে।
–সবই যখন এতদিন ধরে বুঝেছ, তখন এমন কিছুই বোঝনি ভান করতে কেন?
—তোমার কোন অসুবিধে ঘটাতে চাইনি, আর—
–আর?
—আর এ সময়টার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম—কখন তুমি চলে যাবার কথা বলবে, পাকাঁপাকি সিদ্ধান্ত নেবে।
-ওঃ, বুঝেও ভেজা বেড়ালের মতো চলতে?
—বেড়ালটাকে ভিজিয়ে দেওয়া হয়েছে, ঠাণ্ডায় কাঁপছে। কি করবে সে?
–বঃ ব্রেভো, এত সুন্দর কথা বলতে কবে শিখলে?
–অবস্থাই শিখিয়ে দিল।
এইবার বুঝল জয়িতা, ভুল হচ্ছে। রোবট আবার মানুষ হয়ে উঠছে। প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। এবং সেটার জন্য জয়িতাই দায়ী। যে কোন মুহূর্তে কথাবার্তা অন্যদিকে মোড় নেবে। সাবধান হতে হবে। কাজের কথা সব সেরে ফেলতে হবে। মোটামুটি সারা হয়ে গেছে অবশ্য।
তবু আবার অকস্মাৎ অসাবধানতা—তোমার কোন কষ্ট হচ্ছে না।
–কষ্ট?
—হ্যাঁ, মানে, কোন অসুবিধে–
—অসুবিধে হচ্ছে না। কষ্ট হচ্ছে।
জয় উত্তর অতি স্পষ্ট।
সর্বনাশ। আবার আত্মহত্যাপ্রবণ কথাবার্তা চলে আসছে। জয়িতা করছে কি!
—এই কষ্ট ক’দিনের মাত্র। পরে বই ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া ডিভোর্সের পর তুমি তো বিয়েও করতে পারবে।
—এ কষ্ট আমার চিরদিন থাকবে।
চলে যায় জয়ন্ত। ধীর পায়ে।
.
আলো নিভিয়ে আবার যখন জয়িতা নিদ্রাদেবীর আরাধনায় মগ্ন, তখন রাত তিনটে। শ্রীমঙ্ক চেহারাটা আর আগামীকালের কিছু ঘটনার কাল্পনিক দৃশ্য সিনেমার মতো দেখতে দেখতে ঘুমাবার চেষ্টা করল সে।
সিনেমা সে দেখল-ও বটে! তবে সম্পূর্ণ অকল্পনীয় কয়েকটি দৃশ্য। আজ থেকে বহু বছর আগে, বিয়ের কয়েক মাস পরের সময়ের একটি ছোট্ট টি.ভি. সিরিয়াল। এক পর্বের, আধ-ঘণ্টার মতো।
দৃশ্যটা এই রকম।
…ঠাকুর ঘর। রাধাকৃষ্ণের যুগল বিগ্রহ। নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরোয়া পরিবেশ। মীরাভজন গাইছে জয়িতা…অব শুনি ম্যয় হরি আওয়ন কি আওয়াজ….।
জয়িতার পূজারিণী বেশ। লালপাড় সাদা শাড়ি। খালি গা। আঁচল জড়ানো। অপূর্ব সুন্দরী ভক্তিমতীরূপ। জয়িতা গাইছে কব আও গে মহারাজ…
…হঠাৎ দরজার কাছে জয়রে আগমন। পরণে গেঞ্জি ধুতি। শান্ত সৌম্য চেহারা।
ওদের এই দীনদরিদ্র ভাড়াটে বাড়ির ওরা নিজেরাই একটা নামকরণ করেছিলঃ জয়-জয়িতা। লোকে ভুল কেরে প্রথমে পড়তঃ জয়-জয়ন্তী।
আরাধনার গানে চোখ বুজে থাকা জয়িতা টেরই পায়নি জয়ন্তের চুপিসারে উপস্থিত। তাই বাধ্য হয়ে দরজায় জোরে টোকা মারে জয়ন্ত। টক-টক-টক।
চোখ খোলে জয়িতা, বিস্মিত এবং ব্রিজ।
–একি, এই সময়ে? পুজোর ঘরে?
—কেন, পুজোর ঘরটায় আমার কোন অধিকার নেই নাকি। আমি এতই পাপী—
ধমকের সুর জয়িতার কণ্ঠে—যাও, চান সেরে নাও। কটা বাজল খেয়াল নেই। আজ লেট হলে মাইনে কাটবেওয়ার্নিং দিয়েছে না?
জয়ন্তর মধ্যে নড়বার কোন লক্ষণ প্রকাশ পেল না। সূরাং চোখ বুজে গান শুরু করতে গিয়ে আবার বাধা পায় জয়িতা। জয় মতলবমার্কা উপস্থিতি।
একি, তবু দাঁড়িয়ে আছ? যাও বলছি। বললাম তো–আমি আসছি।
—আর কতক্ষণ?
–মানে?
—মানে—আর কতক্ষণ শুধু দেবতার আরাধনা চলবে। ঘরের প্রাণীটা যে আর ধৈৰ্য্য ধরতে পারছে না। সে তো দেবতা নয়, মানুষ।
জয়িতার কাঁধের আঁচল সরে গিয়েছিল। সেদিকে নজর পড়ে জয়জ্ঞ। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে গায়ের আঁচল ঠিক করে জয়িতা।
–খবরদার, কোন অসভ্যতা করবে না।
—কিন্তু আমার যে ভীষণ ছুঁতে ইচ্ছে করছে তোমায়। একটুখানি, সামান্য, প্লিজ ….
–সাবধান, ওই বাসি কাপড়ে ঠাকুর ঘরে ঢুকবে না কিন্তু। যাও, স্নান সেরে নাও। ভাত ফুটে এসেছে।
জয়ন্ত তবু দাঁড়িয়ে। এইবার তাই সুর নরম করে জয়িতা লক্ষ্মী সোনা আমার যাও—
–যাচ্ছি। কিন্তু আর বেশিক্ষণ ধৈর্য ধরতে পারব না…আরে পতিদেবতাও কিছু পুজো চাইতে পারে। গানটান নাইবা হলো—কিন্তু–
—আবার অসভ্যতা। তুমি যাবে?
হাসতে থাকে জয়ন্ত–যাচ্ছিঃ। বাব্বা, স্বামীকে কেউ এইভাবে দূর-দূর করে ওঠে! জয়ন্ত চলে যায়।
জয়িতাও হাসে-ই, পতিদেবতা!
তারপরে বিগ্রহকে প্রণাম করে, গান শুরু করে।
পরের দৃশ্য :
স্নান সেরে খেতে বসেছে জয়ন্ত। মাটিতে পাত-পাতা। পাশে হাতপাখা হাতে জয়িতা। জয় পরনে সুপারভাইজারের ইউনিফর্ম। কারখানার।
জয়িতার নজর যায়জামার একটা বোম নেই।
–আঃ, আবার সেই ছেঁড়া জামাটাই গায়ে দিলে। কেন আরেকটা যে ইস্ত্রি করে রাখলাম।
জল খায় জয়-ওটা এখন প্রলে চলবে না। কাল ফ্যাক্টরিতে আমাদের একটা গেট-টুগেদার আছে। কারখানার ওয়ার্কাস রিক্রিয়েশন ক্লাবের প্রতিষ্ঠা দিবস। মালিক শ্রীমবাবু আসবেন। ওটা তাই কালকের জন্য ভোলা থাক। আজ এটা দিয়েই
মুখ ধুতে ধুতে আরেকটা সারপ্রাইজ ঘোষণা করে জয়ন্ত—তাড়াতাড়ি ফিরব। নাইট শো সিনেমায় যাব—ভুলে গেছ?
–একে দেরি করে যাচ্ছ, কি করে তাড়াতাড়ি ফিরবে?