–কি হয়েছে?–উৎকণ্ঠিত জয়ন্ত।
–মুখটা ধুয়ে আমার ঘরে এখুনিই একবার এসো।
যো হুকুম! আজ বেশ কয়েক মাস হয়ে গেল জয়ন্ত শুধু জরুকা-গোলাম নয়; কেমন একটা রোবটে পরিণত হয়ে গেছে।
নিজের ঘরে দুগ্ধ ফেনিল শয্যার ওপর বেশ রিল্যাক্স করেই বসল জয়িতা। জয়ন্ত সামনে দাঁড়িয়ে। একটা চেয়ার রয়েছে। কিন্তু বসার স্কুম না হলে
—বেচারা!—আবার মনে মনে হাসল জয়িতা। বলল বসো।
যো হুকুম! বসল জয়ন্ত। যেন মালকিনের পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় বিশ্বস্ত ভৃত্য কৃতার্থ হলো বসার মর্যাদা পেয়ে।
–শোন, কালকে কথাটা বলার সময় হবে না। সকাল থেকেই ব্যস্ত থাকব। তাছাড়া একেবারে শেষ মুহূর্তে জানালে তোমারও কিছু অসুবিধা হতে পারে। তাই
জয়ন্তের ভাবলেশহীন মুখ। আজকাল প্রতিক্রিয়া বিশেষ বোঝা যায় না, তাছাড়া রোবটের আবার প্রতিক্রিয়া কিসের। কিন্তু এই মুহূর্তে জয়িতার কথায় রোবটের চোখেও যেন এক বিস্ময়ের প্রশ্নালু দৃষ্টি জেগে উঠল। কিন্তু কোন কথা নেই!
সামান্য ‘পজ’ দিয়ে জয়িতা বলল—খুব একটা নতুন ব্যাপার নয়। আমার ধারণা—তুমি এতদিনে বিষয়টা বুঝেছ।
আবার পজ, সংক্ষিপ্ত বিরতি কথার মধ্যে, পারফেক্ট ড্রামাটিক সাসপেন্স, বজায় রেখে।
রোবটের প্রশ্নালু দৃষ্টি আরেকটু গভীর হলো মাত্র। কিন্তু এখনও কোন বাক্যস্ফুর্তি নয়।
জয়িতা বুঝল-আর ভণিতা করে সময় নষ্টে লাভ নেই। এ হেন আকাট লোককে সোজাসুজি ‘হিট’ করাই ভালো। এরা বোধহয় সফিস্টিকেটে ভাষা বোঝে না। শিল্পসম্মত কলা-কৌশল, ভঙ্গী, ইঙ্গিত এদের বুদ্ধির অগম্য।
-শোন, কাল আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আর ফিরব না। আমার সামান্য কিছু জিনিষপত্র পরে নিয়ে যাব। তুমি এই ফ্ল্যাটে ইচ্ছে হলে থাকতে পার, বা অন্যত্র খুশি মতো কোথাও চলে যেতে পার। সেটা তোমার ব্যাপার।
ফ্ল্যাট! সত্যি এটা তো ফ্ল্যাট। যার ভাড়া প্রায় দু’হাজার টাকা। এবং সেটা শ্ৰীমন্ত মুখার্জী একটা এক্সেপশনাল ফেবার করে জয়ন্তকে দেন। এই রকম এইচ. আর. এ —অর্থাৎ হাউস রেস্ট অ্যালাউন্স জয়ন্তর মতো সুপারভাইজার-এর পাওয়ার কথা নয়। তবু পেয়েছে জয়ন্ত, এবং কেন পেয়েছে-সেটা বুঝেছে কিনা কে জানে। এই স্পেশাল অফারটার সময় অস্ফুট মৃদু প্রতিবাদ করেছিল বটে। কিন্তু শ্ৰীমন্ত মুখার্জী মালিক, তার উপর সুবক্তা।
আমাদের এই কারখানা আসলে একটা ফ্যামিলি। লক্ষ করেছ—এখানে লেবার ট্রাবল হয় না। আমার বাবা এটাকে মানি-মেকিং-মেশিন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেননি। আমিও সেই ট্রাডিশন মেনে আসছি। আমার কারখানায় সিনসিয়ারিটির দাম সবচেয়ে বেশি। অ্যান্ড আই ফাউন্ড ইউ টু বি আ ভেরি সিনসিয়ার ওয়ার্কম্যান। সো দিস ফ্ল্যাট আলাউয়েন্স ইজ আ রিওয়ার্ড টু ইউ।একটা ভালো দেখে ফ্ল্যাট খুঁজে নাও তাড়াতাড়ি। সাউথ ব্লকে পাবে। পেতে অসুবিধে হলে, আমায় জানিও।
-স্যার, আমি এতটা আশা করতে পারিনি, আপনি সত্যিই—
–প্লিজ স্টপ। আমার কোন কথা এর মধ্যে নেই।
জয়ন্ত কোনমতে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে আসছিল। শ্ৰীমন্ত মুখার্জীর জলদগম্ভীর ডাক শুনে আবার দাঁড়াতে হলো।
—শোন। রিমেম্বার দিস অফার ইজ টেম্পোরারি। এভিরিথিং ডিপেন্ডস্ অন হাউ ইউ ক্যারি অন….ও.কে?
-ইয়েস স্যার।
—ফ্ল্যাটে শিফট করেই আমাকে জানাবে। তোমার বাড়ির পুরনো মালপত্র বিশেষ নিও না। আমার ইনটিরিওর ডেকর ওটা সাজিয়ে দেবে। এর ফাইনেন্সিয়াল সাইডটা তোমাকে ভাবতে হবে না। .ধরে নাও, দিস উইল বি মাই গিফট টু জয়িতা—সেদিন ওর গান আমাকে সত্যিই চামড় করে দিয়েছিল—অ্যান্ড আই প্রমিজড় হার আ রিওয়ার্ড।
শ্ৰীমন্ত কথা থামিয়ে জয়ন্তর প্রতিক্রিয়া লক্ষ করছিলেন। বিস্মিত জয়ন্ত আরও হবাক। বাশক্তি ফিরে পেয়ে আবার ‘ধন্যবাদ’ বলতে চাইল, কিন্তু গলার স্বর জড়িয়ে গেল।
–কাট ইট। ঐ থ্যাংকস গিভিংটা আমি জয়িতার মুখ থেকে শুনতে চাইব। …সো লঙ…
অর্থাৎ এখন তুমি যেতে পার। ভদ্র ভাষায় ‘গেট-আউট’।
কিন্তু তখনও কি জয়ন্ত বুঝেছিল তাকে জয়িতার জীবন থেকেও ‘আউট’ করে দেওয়া হবে? কে জানে!
ঢং! রাত্রি আড়াইটা। সতেরই জুন তো বারোটার পর থেকেই শুরু হয়ে গেছ। বেলা বারোটা আর মাত্র সাড়েন’ঘণ্টা দূরে। শ্রীমন্তের প্রতীক্ষা অবসানের এবং চূড়ান্ত সিদ্ধারে ডেলাইন।
এখনও কোন প্রশ্ন এলো না রোবটের মুখ থেকে।
বেপরোয়া জয়িতা তাই নিজেই এবার প্রশ্ন করতে বাধ্য হলো। লোকটাকে দিয়ে কিছু কথা বলাতেই হবে!
–ধারণা করতে পারছ নিশ্চয়—কোথায় যাচ্ছি।
–না। এতক্ষণে মুখ খুলল রোবট।
—শিট!
ক্ষিপ্ত, ডিসগাস্টেড জয়িতা ভাবল–এই লোকটাকে নিয়ে এতদিন সে ঘর। করেছে কি করে। অবশ্য সাথে সাথে এটাও ভাবতে বাধ্য হলোনা, লোকটা প্রথম থেকে তো এমন ছিল না। সাত-আট মাস হলো এমন বদলে গেছে। যেন অর্ধ-উন্মাদ।
তাই একটু ভয়ও জেগেছে জয়িতার মনে। সব কিছুই যারা মানতে থাকে, সব কথাতেই ইয়েস বলে—তারা ঠিক সুবিধের হয় না।
অ্যাবরাপ্টলি জ্যাম্পকাটের টেকনিক্ নিল জয়িতা। কাগজপত্র পরশু পেয়ে যাবে। সই করে দেবে। তারিখ বসিও না।
রোবট চুপ।
—কি এখনও বোঝনি, কোথায় যাচ্ছি আমি। আর কি ঘটতে চলেছে? আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে?
–বুঝেছি।
—কি বুঝেছ?
–যে ঘরে, যেখানে তোমায় মানায়, তুমি সেই ঘরে যাচ্ছ।