—কিন্তু কি?
—জয়রে কি দোষ?
—ওর দোষ ওর অযোগ্যতা। ওর দারিদ্র। তোমাকে যেখানে ঠাই দেওয়ার কথা, সেটা দেবার ক্ষমতা ওর নেই।
সেটা ছিল শ্ৰীমন্ত মুখার্জীর চতুর্থ আগমন। জয়ন্ত জয়িতার দীর্ণজীর্ণ ঘরে। জয়ন্ত তখন দোকানে মিষ্টি কিনতে গেছে। হঠাৎ বসে’র গাড়ির হর্নে বিস্মিত হয়ে আপ্যায়নের সাধারণ নিয়মটুকু মানবার জন্য তাকে ছুটতে হয়েছিল বাইরে—পকেটের সামান্য কয়েকটা টাকা সম্বল করে, বিশাল বিমূঢ়তা নিয়ে।
জয়িতা ব্যস্ত হয়েছিল রান্না ঘরে যেতে। চা করতে। কিন্তু জয়িতার একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরেছিল শ্ৰীমন্ত। শ্ৰীমন্তর কঠিন মুঠোতে জয়িতার হাত যেন বন্দী হয়ে হারিয়ে গিয়েছিল।
-এখুনি চা করতে ব্যস্ত হতে হবে না।
–বসুন, পাখাটা পাড়ি।
–না, তারচেয়ে আমরা বারান্দায় দাঁড়াই। সুন্দর হাওয়া আসছে।…. আচ্ছা একেই কি ‘দখিনা পবন’ বলে?
কারখানার মালিক-এর মধ্যে এত কবিত্ব!
জয়িতার মুগ্ধতা স্বাভাবিক।
এবং ঠিক যে সময়ে সিঙ্গাড়া-আর রসগোল্লা কিনে, পকেটের পাই-পয়সা উজাড় করে বাড়ির দিকে ছুটছিল জয়ন্ত, হাঁটাপথে এখনও প্রায় দশ মিনিট—তখনই শ্ৰীমন্ত জয়িতাকে কাছে টেনে নিয়েছিল। সেই অন্ধকার বারান্দায়। বলেছিল— কোন ভয় নেই, আমি তোমায় চিরকালের জন্য চাই। সামাজিক মর্যাদা দিয়ে চাই। আমার অতীত ভুলিয়ে দাও। আমার কাছে এসো।
—কিন্তু আমার এই ঘর—
এ ঘরে তোমাকে মানায় না।
শ্ৰীমন্তের আলিঙ্গনাবদ্ধ জয়িতা বাকরুদ্ধ। শ্ৰীমন্ত এখন প্রতিশ্রুতি চাইছে—
—তুমি কথা দাও—
ঠিক তখুনিই কি উত্তর দিত জয়িতা তা সে নিজেও জানে না। তাই বোধহয় ‘ঠুং’ করে কলিং বেলটা বেজে উঠল। খাবারের প্যাকেট হাতে জয়ন্ত দ্বারের ওপারে। মালিকের আপ্যায়নের জন্য মরিয়া। যদিও মালিক ইতিমধ্যেই নিদারুণ অ্যাপায়িত বোধ করেছেন। পকেটের শেষ পয়সা দিয়ে জয়ন্তের আনা সিঙ্গাড়া রসগোল্লা তাই মূল্যহীন।
শ্ৰীমন্ত মুখার্জী শুধু হেসে বলেছিলে—তুমি আবার ছুট মারলে কোথায়? আমি চা-ছাড়া কিছু খাব না।
তাই সেইরাতে ঘরে বজ্রপাতটা তো জয়ন্তই নিমন্ত্রণ করে ডেকে এনেছিল। আগের ঘটনাগুলো থেকেই তো চোখের ঠুলি খসে পড়ার কথা। তাই বজ্র কহে, দূরে আমি থাকি যতক্ষণ’—তখন কেউ আমার অস্তিত্ব টের পায় না। মাথায় পড়িলে তবে বলে বজ্র বটে।
ঠিক তাই। জয়ন্তের মাথায় বাজ ফেলেই টের পাওয়াতে হলোবাজ পড়েছে বটে।
আজ রাতে তাই বেচারা, পুওর ফেলো জয়ন্তকে এখন—প্রায় মাঝ রাতে তুলতে হবে। নাকি, কথাটা কাল বললেও চলবে?
চিঠিটা খামে এঁটে একটু ভাবল জয়িতা।
না, না, কেমন যেন টেনশন হচ্ছে। এখন মনটা ঠিক মুডে আছে। কাল দিনের বেলা ‘পুওর ফেললা’র গোবেচারা মুখ দেখে আবার যদি ধন্দ শুরু হয়।
না, এখনই বিহিত করতে হবে। এই ক-মাস প্রচুর ভাবনা-চিন্তার সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। অনেক সময় পার হয়ে গেছে। কাল শ্ৰীমন্তর—জন্মদিন। কোন অনুষ্ঠান হচ্ছে না। শ্ৰীমন্দ্র বিশাল ড্রইংরুমটা অবশ্য নতুন সাজে সাজবে। ফুল ভালোবাসে জয়িতা। তাই ফুলের আসর বসবে। আর শ্ৰীমন্তর একান্ত সাধ—ফুলের গয়না পরবে জয়িতা!
গাড়ি আসবে কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে ছ’টায়। জয়িতা শ্ৰীমন্তর বাড়ি পৌঁছবে সাতটা? আটটায় আসবেন কয়েকজন। রেজিষ্ট্রেশন ম্যারেজের notice এ সই করবে।
শ্ৰীমন্ত ও জয়িতা। তারপর
তারপর কি, জয়িতাও জানে না।
কিন্তু এত পরিকল্পনা অনেক আগে জেনেও, বহুবার শ্রীমত্র বান্ধনে ধরা দিয়েও, বহুবার ঠোঁটের লিপস্টিকের আস্তরণ নষ্ট করেও, পরিষ্কার হ্যাঁ’-টা বলা হয়ে ওঠেনি জয়িতার।
তাই পরশু আল্টিমেটাম এসেছে। বিরহ-যাতনার অভিমানী বিদায়সম্ভাষণঃ ‘আগামী সতেরই জুন আমার জন্মদিন। ঐ দিন আমার আটচল্লিশ বক্স পূর্ণ হবে। উনপঞ্চাশে পা দেওয়ার মুহূর্তটা যদি আমার একা কেটে যায়, তবে বাকি জীবনটাও তাই কাটবে—যেমন কেটে এসেছে।
…মাঝে মাত্র একটা দিন, একটা রাত। কাল ২৭ জুন, আমাকে মানসিকভাবে হত্যা করার জন্য অথবা নতুন জীবন দানের জন্য তুমি দায়ী থাকবে। আমি ১৭ জুন সকাল বারোটা পর্যন্ত তোমার উত্তরের অপেক্ষায় থাকব। বারোটা পার হয়ে গেলে…কি হবে, আমিও জানি না। …শ্ৰীমন্ত।
সর্বনাশ।
এখন রাত দুটো। কাল সকাল বারোটা তো এসে গেল।
ড্রেসিং গাউন জড়িয়ে দরজা খুলে বাইরে এসে লাউঞ্জের আলো জ্বালল জয়িতা। বেশ ভালোই জানে সে-জয়য়ে ঘুম পাতলা। তবু একটু উঁচু স্বরেই ডাকল—একবার একটু উঠতে হবে। দরকার আছে।
অ্যাজ এক্সপেক্টেড, ধড়মড় করে উঠে বসল জয়ন্ত। সোফা-কাম-বেডে তাড়াতাড়ি উঠে বসতে গিয়ে চাদরটা মুখেনাকে জড়িয়ে একটা কৌতুকবহ অবস্থার সৃষ্টি করে ফেলল, তাই এত সিরিয়াস সুগম্ভীর অবস্থাতেও হাসি পেল জয়িতার আহা, বেচারা। বড় ঘরটা এক সুন্দর সাজানো ড্রইং রুম যেখানে শ্ৰীমন্ত এসে বসে। তাই পত্নীপরিত্যক্তা স্বামীর আলাদা কথা এই ইনসাইড লাউঞ্জ। শয্যা সোফা কাম বেড। এখানে তো খাটিয়া পাতা সম্ভব নয়। প্রথমে একটা ক্যাম্প-খাট ছিল। ক্রমশ জয় শয্যা প্রমোশন পেয়ে এখন একটা সোফা কাম-বেড পেয়েছে। দিনের বেলা এটা সোফা, রাতে বেড।
স্বামীর স্পর্শ ও সংস্পর্শ–বিশেষ করে নৈশকালীন সংস্পর্শ—এড়াতে এর চেয়ে সুন্দর ও সহজ উপায় আর কি আছে?