ছায়া গোধূলি – উত্তম ঘোষ
…অনেক ভেবে মনস্থির করে ফেলেছি। তোমার দুই চোখের অতলগভীর দৃষ্টির আহ্বানকে ফিরিয়ে দেবার শক্তি আমার নেই। কাল তোমার জন্মদিনের সানন্দক্ষণে তুমি আমাকে আপন করে নিয়ে একান্ত নিভৃতে যে শপথ গ্রহণ করবে, সেই হবে আগামী দিনে আমাদের মিলন স্বর্গ রচনার শুভ সূচনা। …কোন ভয়, কোন সংকোচ আর নেই। কথা দিলাম, আমি আসছি, তোমার কাছে, চিরদিনের জন্য। …
‘তোমার, এবং এখন একমাত্র তোমার জয়িতা’—
এই কথা ক’টাও লেখা হয়ে গেল।
রাত একটা।
টেবিল ল্যাম্পের আলোর নীচে জয়িতার লেখা মুক্তোর মত অক্ষরগুলো হাল্কা নীল রাইটিং প্যাডে মনে হতে পারে সন্ধের আকাশের গায়ে কতগুলো ছেঁড়া ছেঁড়া কালো মেঘের টুকরো। কালো, কিন্তু উজ্জ্বল। কালো। জগতের আলো।
পাশের ঘরেনা, ঠিক পাশের ঘর বললে ভুল হবে, ঘরের বাইরে লাউঞ্জে একটা সোফা কাম-বেডের ওপর জয়র চাদরমুড়ি দেওয়া অস্তিত্বটাকে এখুনিই একটু খোঁচা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ হচ্ছে। যদিও অনেক রাতে খাটাখাটুনির পর শুয়েছে। বেচারা, হ্যাঁ, জয়িতার এই মুহূর্তে সব মিলিয়ে জয়ন্তকে একটু বেচারা’, দ্য পুওর ফেলো, মনে হচ্ছে বৈকি!
–কিছু বলেই ডাকতে হবে না।
–তার মানে।
—আমাদের মধ্যে ডাকাডাকির পর্ব শেষ হয়ে আসছে।
কিছুক্ষণের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল জয়ন্ত। সত্যি, সে এতখানি কল্পনা করেনি। অনেক গুজব কানে আসছিল, পথে-ঘাটে। অফিসে, দু-চার জন তথাকথিত বন্ধুর মুখেও লাউঞ্জে সোফাঁকাম-বেডে জয়ন্তের শয্যাগ্রহণ শুরু হয়েছে প্রায় একবছর আগে। ভালোই মনে আছে জয়িতার—এবং জয়ন্তেরও কবে শেষ তারা এক শয্যায় নিশিযাপন করেছিল। এবং কবে শেষবারের মতো—এই বিশাল সুন্দর আধুনিক দ্বি শয্যার আশ্রয়ে তারা একত্র হয়েছিল নিতান্ত দ্বিধাগ্রস্ততার মধ্যে! এবং সেই নিতান্ত মেকানিকাল এক উপভোগ্যতার শেষে তাদের বাকি রাতের কথাবার্তাগুলো দুজনের কারুর পক্ষেই এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবার নয়।
—আর অভিনয় করতে পারছি না—জয়িতা আক্ষেপের সুরে স্পষ্টই বলে ফেলেছিল।
—অভিনয়?—জয়ন্ত বোধহয় বুঝেও না বোঝার ভান করছিল। অর্থাৎ সে-ও অভিনয় করছিল। অন্তত জয়িতার তাই মনে হয়েছিল।
-হ্যাঁ, আজ সাত-আট মাস ধরে আমি অভিনয় করছি। কিন্তু খুব কাঁচা ভাবে, হেলাফেলা করে যাতে তুমি সেটা ধরে ফেলতে পার। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে হয় তুমি ধরতে পারছ না আমার ছদ্ম আচরণগুলো, আর নয়, ধরতে চাইছ না—ইচ্ছে করেই হয়তো।
—আমি কিন্তু সত্যি তোমার কথার মানে ধরতে পারছি না জয়ি—
–প্লিজ আমাকে নাম ধরে ডাকাটা বন্ধ কর।
–সে কি, কি বলে ডাকব তাহলে?
—কিছু বলেই ডাকতে হবে না।
–তার মানে।
—আমাদের মধ্যে ডাকাডাকির পর্ব শেষ হয়ে আসছে।
কিছুক্ষণের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল জয়ন্ত। সত্যি, সে এতখানি কল্পনা করেনি। অনেক গুজব কানে আসছিল। পথে-ঘাটে, অফিসে, দু-চার জন তথাকথিত বন্ধুর মুখেও কিছু কিছু কথা সে শুনে আসছিল। জয়িতার কিছু বেপরোয়া আচরণ এবং উত্তরোত্তর তার বৃদ্ধি কলায় কলায়, এবং পাড়ায় নানা বয়সি রাশি লোকেদের ফিসফিস—এমন কি কিছু রোয়াকের ছেলের মুখ ঘুরিয়ে ছুঁড়ে মারা পরোক্ষ মন্তব্য–সব কিছুই বলছিল—সামথিং ইজ রং।
তারপর এই ব্যাপারগুলো, হুইস্পার ক্যাম্পেন ইত্যাদি বেশ সোচ্চার এবং স্পষ্ট হয়ে উঠল। কিছু ‘চক্ষেণ পশ্যতি’ ব্যাপারও ঘটল। তবু জয়ন্তর মন বলছিলনা, অসম্ভব, এ হতে পারে না। সারাজীন অভাবে কাটিয়েছে জয়িতা, এখন একজনের কল্যাণে সে একটু সুখের মুখ দেখতে পাচ্ছে তাই সাড়া দিচ্ছে। এর বেশি কিছু নয়।
আজ পাঁচ বছরের বেশি হয়ে গেল—জয় শ্রীহীন সংসারের শ্রীবৃদ্ধির কোন সম্ভাবনাই ছিল না। গয়না, কসমেটিক্স দুরের কথা, একটা ভালো শাড়ি কোনদিন স্ত্রীর হাতে তুলে দিতে পারেনি জয়স্ত। তাই–
কিন্তু, তাই কি? জয়িতাকে তত বিয়ের পর থেকে টানা চার বছর একবারও মনে হয় নি টাকাপয়সার টানাটানিতে সে অসুখি! তাই সেই রাতে জয়ন্ত প্রশ্ন করেছিল—কেন, আমাদের ডাকাডাকির পর্ব শেষ হবে কেন?
জয়িতা জ্বলন্ত দৃষ্টিবাণ ছুঁড়ে বলেছিল–তুমি কি অন্ধ?
সত্যিই জয়ন্ত অন্ধ। নইলে আরও স্পষ্ট করে উত্তর শুনতে চেয়েছিল কেন? যে উত্তর শোনার আগে তার বধির হওয়া ভালো ছিল। চোখ এবং কান থাকতেও সে বোধহয় অন্ধ ও বধির হতেই চাইছিল।
—আমি কিন্তু সত্যি কিছু বুঝঝি না।
—তবে শোন, আমি শ্ৰীমন্ত মুখার্জীকে ভালবাসি।
ঘরে বজ্রপাত হয়েছিল। কিন্তু তাই বাজপড়া একটা গাছের মতো হয়ে গিয়েছিল জয়ন্ত। আর জয়িতাকে মনে হচ্ছিল একটা রূপোলী সাপ—যেটা বিদ্যুৎ হয়ে বাজটাকে ডেকে এনেছিল।
দোষটা তো জয়ন্তেরই। তার কারখানার মালিক শ্ৰীমন্ত মুখার্জির সাথে কোন প্রতিযোগিতার প্রশ্ন ওঠে না। মুখার্জি এন্টারপ্রাইজ-এর একমাত্র কর্ণধার শ্ৰীমন্ত সত্যি শ্রী ও শোভায় মস্ত। তার পাদনখকণা জয়ন্ত। তাই শ্ৰীমন্ত যখন জয়িতাকে আহ্বান জানিয়েছিল, বলেছিল— আমি কোন জোর করব না। দাবি জানাব না। শুধু আবেদন করব। তুমি আমার ঘরে এসো
—কিন্তু–চমকিত জয়িতা সেই সন্ধেবেলা চমকেছিল, আবার পুলকিত হয়েছিল। অপরাধবোধের সাথে চোখের সামনে ঝলকানি দিচ্ছিল এক অনন্ত সুখের জগৎ—বিশাল বাড়ি, অতি সুন্দর গাড়ি, আর শিক্ষিত রুচিশীল বড়লোক এক পুরুষের ডাক। হোক না তার বয়স একটু বেশি, কিন্তু তার দেহের সৌন্দর্য অটুট। মনের সৌন্দর্যও মুগ্ধ করার মতো। সত্যি শ্ৰীমন্ত।