একটা ‘গোঁ’-এর ভেতর থেকে এক কথা বারবার বলে চলেছেন। শ্রাবণীর কি খেয়ালে রয়েছে। অনিল এখন হাসপাতালের আই সি সি ইউতে? বাঁচবে কি বাঁচবে না ডাক্তাররাও জানেন না।
শ্রাবণীর খেয়ালই নেই। তিনি সেই তখন থেকে নিজের হেরে যাওয়ার বিরুদ্ধে লড়েই চলেছে। কার সঙ্গে? জানেন না। তবু এই লড়াই লড়ছে—আজ শশা দিয়ে শখের দাগ উঠিয়েছি। কার জন্যে। বল? কার জন্যে? তোমাকে ‘শ্রী’ থেকে ‘মিস্টার’-এ উঠিয়েছে কে? জান না? শুয়ার। বাটামাছের ঝোল না খেয়ে আঙুর খাওয়া হয়েছে? কার সঙ্গে রে? পোষমানা কুকুর? শ্রাবণী হাঁপালেন। শ্রাবণী কাঁদলেন। শ্রাবণী বোধহয় শুয়ে পড়লেন। দুঃখের কান্নার ভেজানো সেই সুখের বালিশ-এ। রাতের পর সকাল আসে। জাপানে আসে। সাইবেরিয়ায়। বেহালাতেও এসেছিল। বেহালার সকাল, সকাল সকাল এসে দেখল, শ্রাবণী দাঁতও মেজে একদম তৈরি।
শ্রবণা বলল, মা তুমি যাচ্ছ? আমি যাব? শ্রাবণী হাসলেন। সে হাসিতে আনন্দ মজা কিছু ছিল না। শুধু ক’খানা দাঁত বার করতে হয়, তাই। মুখে বললেন, অনার্স ক্লাশগুলো করে আয়। আমি তো থাকবই। মনে মনে খুব বিশ্রিভাবে হাসলেন। সেই খ্যানখেনে হাসির ভেতর, মনে মনেই বেরিয়ে এল, আমি তো যাচ্ছি সতীনের খোঁজে। মায়ের সতীন দেখতে তোর ভাল লাগবে?
শ্রবণা অনেকক্ষণ মায়ের দিকে চেয়ে কি যেন খোঁজবার চেষ্টা করল, খুঁজে পায়নি। আজ তিনদিন। শ্রাবণী আসেন। আই সি সি ইউ-এর বাইরে এই টুলটায় ঠায় বসে থেকে লক্ষ করেন, অনিলকে দেখতে কে এল। এসেছে অনেকে। তবে মহিলা বিশেষ নয়। যারা এসেছিল সবাই তো কাছের আত্মীয়া। আজ দুপুর বেলা হঠাৎ শ্রাবণী জানেন না কেন, সেই ছেলে দুটোর কথা খুবই মনে হল—-ওদের ঠিকানা রাখলেই হত। ওরাই তো ব্যাগ খুলে বাড়ি আর দোকানে ফোন করেছিল। আচ্ছা, কনডোম দুটো কি ওদের চোখে পড়েছিল? ওরা কি দেখেছে? অনিল যখন মাথা ঘুরে পড়ে যায় তখন কেউ ওর পাশে ছিল কি না? ইস বড্ড ভুল হয়ে গেছে। এখন সতীনকে কোথায় খুঁজে পাই…? টুলের উপর চুপটি করে বসে, শ্রাবণী মনে মনে বকবক করেই চলেছেন।
শ্রবণা এসেছিল। বাবাকে দেখে গেছে।—সেই একই। মাকে ওঠাতে পারেনি। সন্ধ্যায় আবার আসবে বলে ফিরে গেছে। বিকেল শেষের আগে এক দঙ্গল এলেন। মহিলাই বেশি। শ্রাবণী এঁদের চেনেন না। শাড়িব্লাউজ মাখানো পারফিউমের গন্ধে হাসপাতালের ওষুধ গন্ধ উধাও। সবার পেছনে মল্লিকবাবু ধীর পায়ে উঠে এসে বললেন, এঁরা বেহালা বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিত্রি সব কমিটি মেম্বার। অনিলের কথা শুনে খুব শোক পেয়েছেন। ‘শোক’ কথাটা কানে যেতে শ্রাবণী সবার হাতের দিকে তাকালেন-যাক বাবা! সন্দেশ কিংবা রজনীগন্ধা আনেনি।
শ্রাবণী এক একজনের দিকে আড়চোখে চাইছে, মানে, এক একজন মহিলার দিকে। আর তৎক্ষণাৎ + চিহ্ন-সেঁটে দিচ্ছেন। এক দুই করে সবার গায়েই দেখলেন,—চিহ্ন আঁটা। কেবল একজনের গায়ে শ্রাবণী খুব অবাক হয়ে দেখলেন, বয়স বোঝা যাচ্ছে না। চল্লিশও হতে পারে। কিংবা কম। পুরুষ্ট গা হাত পা শুধু নয়, বেশ মোটার দিকে। সাদা শাড়ি-ব্লাউজ এর গা বেয়ে না দেখা একটা খাই খাই গন্ধ উঠে আসছিল। অনিলের খুব কাছে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকার ভেতর আড়ে আড়ে শ্রাবণীকেও দেখে গেলেন—আমার সঙ্গে নিজেকে তুলনা করছে নাকি? শ্রাবণী মনে মনে বিড়বিড় করলেন—ওই তো ছিরি। আমার এই স্লিম ফিগারের পাশে, ওই টপ মার্কা চেহারা। দাঁড়াতে পারবে? সাহস আছে বলতে হবে।
খুব গভীর গোপন চিন্তার ভেতরেই শ্রাবণী হঠাৎ হোঁচট খেলেন—স্লিম ফিগার। আমার? কিন্তু ওই স্লিম ফিগারকে তো অনিল ইদানীং তেমন করে চাইছিল না। তেমন করে কেন? চাইছিলই না তো। মুখে না বললেও, আমি কি বুঝিনি? আমাতে কি অরুচি এসেছিল। ‘অরুচি’ শব্দটা কোথা থেকে যেন একদলা বমি নিয়ে এল। শ্রাবণী এখন খুব শক্ত। এতটুকুও বমি না করে ড্যাবড্যাব চোখে দেখলেন, সাদা শাড়ি ব্লাউজের সারা গায়ে + চিহ্ন, + চিহ, আর + চিহ্ন।
হেরে যাবার কান্না কাদলেন। মনে মনে। অনেকক্ষণ ধরে।
এখন অনেক রাত। গভীর রাতে গোপন কান্নারা খুব সহজে বেরিয়ে আসে। শ্রাবণীর বেলায় তেমন কিন্তু হল না। হাসপাতালেই কান্নার কোটা বোধহয় শেষ করে এসেছেন। সেই শেষ বিকেল থেকেই ভেবেছিলেন, লুকোনো সতীন এতক্ষণ পাকড়াও হয়েছে। কিন্তু তা তো নয়। + চিহ্ন মার্কা সাদা শাড়ি বেশ ভালো। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দুটো হাত ধরে কেমন বললেন, শ্রাবণী দেখা হল। কিন্তু বড্ড অসময়ে। অনিলদা ভালো হয়ে উঠুক। তোমাদের আমি বোয়াল মাছের পাতুরি খাওয়াব। খেয়েছ? কোন ভয় নেই। তোমার মুখ দেখেই বুঝেছি। এমন মেয়েকে বেশি দিন কষ্ট পেতে হবে না। চলি। ভালো থাকবে। খুব ভালো।
সতীন খোঁজার সব রাস্তাগুলোই বন্ধ। কোন মেয়ে কি সতীন হতে চায়? কেউ নয়। কেউ নয়। মেয়েরা তো মেয়ে। অনেক ঘেরাটোপ দিয়ে নিজেদের ঘিরে রাখে।
সেই ঘেরাটোপ খুলে একদিন তিনি বেরিয়ে এসেছিলেন। চেতলার ‘ফুলছাদ’ থেকে বেহালার একতলার বাড়িতে। অনেকগুলো সিঁড়ি নামতে হয়েছিল। কম বয়সের উচ্ছাসে নেমে আসাটা সেদিন চোখে পড়েনি। বেহালার বাড়িও ধীরে ধীরে তিলা করেছিলেন। এখানেও ফুল ফুল সবই আছে। তবে…, আজ এই বয়সে এসেও শ্রাবণীর মনে হল,—ওগুলো বোধহয় প্লাস্টিকের নকল ফুল। জাঁক আছে। কিন্তু ফুলের হৃদয়ের গন্ধ কোথায়? চারপাশ ঘিরে যা কিছু করেছি সবটাই কি এমন হৃদয়হীন? জাঁকসর্বস্ব। তা না হলে…।