মেহবুব সাহেব হেসে বললেন—শুনেছে ঠিকই। এক মারাত্মক বিস্ফোরণে আমার এই রকম দশা হয়েছিল। একটা পা গেছে। মুখটাও পুড়ে ঝলসে গেছে। দৃষ্টিশক্তিও হারিয়েছিলাম। তবে বহু চেষ্টার পর এবং বহু চিকিৎসার পর দুটি চোখেই অল্প অল্প দেখতে পাই। কিন্তু এ কথা আমি কাউকে বলিনি। এমনকি আমার স্ত্রীকেও না।
আমি অভিভূত হয়ে বললাম-কেন?
—আসলে আমার স্ত্রীকে আমি খুব ভালবাসতাম, আপনিই বলুন না কেন ওইরকম একজন নারীকে ভালো না বেসে কি পারা যায়? তা যাক। যখন বুঝতে পারলাম আমার এই অবস্থার পর ও অন্যের অনুগামী তখন মনে মনে খুবই দুঃখ পেলাম। কিন্তু সব জেনেও ওকে আমি বাধা দিই নি। নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে নিয়েছিলাম। পরপুরুষের সঙ্গে ও উপগত হোত। এক বিছানায় শুতো। সবই দেখতাম! এমন কি আমাকে অন্ধ ভেবে আমার সামনেই পরস্পরকে আলিঙ্গন চুম্বন করত। সব সহ্য করেছিলাম। কিন্তু যখন টের পেলাম ওরা অবাধ স্বাধীনতা পাবার আশায় আমার প্রচুর ধনসম্পত্তি আত্মসাৎ করে বরাবরের জন্য এখান থেকে পালাবার চেষ্টা করছে তখন আর থাকতে পারলাম না। প্রতিহিংসা নেবার জন্য তৎপর হলাম এবং ওদের একজনকে হত্যা করে প্রতিশোধ নিলাম। তারপর আমরা স্ত্রী যখন আপনার সঙ্গে দেখা করবার চেষ্টা করল তখনও আমি ওর পিছু নিয়ে সব কিছু দেখলাম। আপনার দরজায় কান খাড়া করে ভেতরের কথাবার্তা শুনলাম। আপনার আদর্শ এবং ব্যক্তিত্বকে অভিনন্দন জানাই। তবে শেষ দিন অবশ্য আপনি ওর কাছে। অন্য একটি প্রস্তাব রেখেছিলেন। কিন্তু জোর করেন নি। তাতে অবশ্য আমি অসন্তুষ্ট নই। কেননা এটা হওয়াই স্বাভাবিক। তবে অর্থলোভে ঐ ঘৃণ্য কাজটি যে আপনি করেননি তার জন্য সামান্য একটু পুরস্কার অন্তত আপনার পাওয়া উচিত। তাই বিভিন্ন ব্যাঙ্কের কয়েকটা চেক আপনাকে দিলাম এবার আপনি যেতে পারেন।
—আপনি?
—ডাক্তার! দেরি করবেন না। মনে রাখবেন আপনি এখনো আসামী এবং পুলিশ আপনার জন্যে দরজার বাইরে অপেক্ষা করছে। আমাকে আমার বাকি কাজটুকু করতে দিন।
আমি চলে এলাম।
তবে ঘরের দরজা পার হবার সঙ্গে সঙ্গেই বন্দুকের গুলির শব্দ শুনে ছুটে গেলাম তার কাছে, থুতনির নীচে বন্দুকের নলটা ঠেকিয়ে ট্রিগার টিপেছেন মেহবুব আলম। টেপরেকর্ডার যন্ত্রেই সেই গুলির শব্দ ধরা পড়েছে। পুলিশের উদ্দেশ্যে লেখা একটা চিঠিও পড়ে আছে টেবিলের ওপর।
ততক্ষণে বাড়ির অন্যান্য লোকজন এবং পুলিশ, বাই ছুটে এসেছে।
টেপ রেকর্ডারে বলা কথা এবং তার চিঠির বিবরণ অনুযায়ী পুলিশ আমার বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগ তুলে নিল এবং আমাকে সসম্মানে আমার বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেল।
বলা বাহুল্য কয়েকদিনের মধ্যে আমি নিজের চেষ্টায় অন্য জায়গায় বদলি হয়ে গেলাম। হেনা আলম আমার সুন্দর জীবনের এক সকরুণ স্মৃতি। এটা তো ঠিক, শুধুমাত্র আমারই গোঁড়ামিতে সেই প্রস্ফুটিত ফুলটিকে অকালে ঝরে যেতে হল। তাই মেহবুব সাহেবের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া ঐ চেকগুলো গ্রহণ করতে বিবেকে বাধল আমার। আসার সময় আমি সেগুলো পুলিশের হাতেই জমা দিয়ে এলাম।
অণুবীক্ষণ – কুণালকিশোর ঘোষ
স্বপনে তাহারে কুড়ায়ে পেয়েছি, রেখেছি স্বপনে ঢাকিয়া…। গানটা এইমাত্র শেষ হল। টিভির অ্যানাউন্সার পরের গানটার প্রথম কলি ঘোষণা করার ভিতরেই শ্রাবণী অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন, উদাস। হুড়মুড় করে ছোটবেলাটা উঠে আসছিল? নাকি তিনি নিজেই দুড়দাড় করে ছোটবেলায় ফিরে ফিরে যাচ্ছিলেন?
মা! চেতলার সেই বিশাল ছাদ-এর ওপর তিন কামরার ফ্ল্যাট! সারা ছাদ ভরে মা কেমন বাগান করেছিল। বাবা হাসতে হাসতে মাকে কতবার যে বলত—এত ছাদ নয়। এ আমার গিন্নির ফুলছাদ। সন্ধেবেলায় আশ্চর্য একটা সোনালি রোদ্দুর মাখা থাকত আকাশে। গুঁড়ো গুঁড়ো বাতাস। কঁক বেঁধে চড়ুইপাখি নামত মায়ের ফুলছাদে। বাবা তখনও ফেরেনি। আমরা দু’বোন চুপটি করে মায়ের গান শুনতাম। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রগীতি, রজনীকান্ত সবই তো মায়ের ওই গুনগুনানি শুনেশুনেই শেখা।
পুরনো ছাদ, পুরনো ফুলের গন্ধ, পুরনো সন্ধেবেলার গানের স্মৃতি এই পুড়ে যাওয়া দুপুরকে ঠেলে ঠেলে দিয়ে কেমন করে যে এগিয়ে এল শ্রাবণী জানেন না।
শ্রাবণীর চোখ বোজা। বোজা দু’চোখের ওপর গোল গোল করে কাটা শশার টুকরো। দেওয়াল ঘড়িটা একটুক্ষণ সর সর একটা শব্দ করল—ঢং। তার মানে দেওয়াল ঘড়ির—একটা। আসলে এখন একটা সাত। পুরনো এই ঘড়িটা ঠিক টাইমই দেয়। তবে সাত মিনিট পিছিয়ে থেকে।
—আমরা এমনিই ভেসে যাই…। পরের গানটা শুরু হয়েছে। এই দুপুর বেলায় এমন গান। কে শোনে? ভাবতে ভাবতেই শ্রাবণীর মনে হল, আমি তো শুনছি। আমার মতো হাজারটা লোক নিশ্চয়ই শুনছে। কিন্তু…? টিভি চালিয়ে কেউ কি শুধু শোনে? দেখতে তো হবেই। কিন্তু আমি?
শ্রাবণীর হাসি পেল। তাকে এখন আধঘণ্টা দু’চোখের ওপর গোল করে কাটা শশার টুকরো রাখতেই হবে। ‘চোখের দু’পাশের কালিমা শশার ছোঁয়ায় উধাও’—পড়েছে। সেই বিখ্যাত রূপচর্চার বইতে।
—এ বড় কষ্টের। শ্রাবণী নিজেকে বললেন।—টিভি শুনব। দেখব না? এ হয় নাকি? রেখেছি স্বপনে ঢাকিয়া…যখন শুনছিলাম তখনও শশা দিয়ে চোখ ঢেকে ছিলাম। কিন্তু এখন? এখন তো মায়ের গুনগুন করে গাওয়া সেই গানটা হচ্ছে। আলোর মতো হাসির মতো কুসুমগন্ধ রাশির মতো শুনতে শুনতে বোজা চোখেই পুরনো দিনের ছাদ থেকে নেমে এসে জানলার পর্দা ফেলা তার এই বেডরুমে ঢুকে পড়লেন।