কি হলো ভিজেবেড়ালের মতো ঘাপটি মেরে গেলে যে? সত্যি কথা বললে অমনই হয়। পাশাপাশি দুটো বালিশ রাখতে রাখতে বলে চন্দ্রা।
বিপিনবাবু খারাপ কিছু বলেনি, উলের পাপোষে পা মুছে বিছানায় উঠে পড়ে মিহির।
ভালটাই বা কি বললো শুনি, মশারিটা খাটের বাইরে ঝেড়ে নেয় চন্দ্রা।
বলছিলো, আজ দুপুরে তোমার বক্তৃতার কথা।
খুব আঁতে লেগেছে বুঝি?
দেখ চন্দ্রা, আমাদের ভেতর একটা বোঝাপড়া করে নেওয়া উচিত। বিছানায় চিৎ হয়ে নিজেকে এলিয়ে দেয় মিহির।
কিসের বোঝাপড়া? খাটের কোণে মশারির দড়ি ঝুলিয়ে দিতে দিতে প্রশ্ন করে চন্দ্রা।
যেমন ধরো আমরা প্রফেশনালি দু’জনে দুই মেরুর উপর দাঁড়িয়ে–আমি ম্যানেজমেন্ট সাইডে, তুমি কর্মচারীর পক্ষে। আবার এ্যাকসিডেন্টালী ব্যক্তিজীবনে আমরা স্বামী স্ত্রী। সুতরাং আমাদের মধ্যে একটা ক্লিয়ার আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকা একান্ত প্রয়োজন। নিজের বক্তব্য বেশ জোরালো ভাবে বলতে পারায় তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে মিহির।
কি আন্ডারস্ট্যান্ডিং চাইছো? মশারি গোঁজা ফেলে থমকে বসে চন্দ্রা।
দেখ নারী পুরুষ আকৃতিগত পার্থক্যে গড়া দুটো জীবন হলেও মূলত তারা মানুষ। সমাজে, সংসারে কিংবা অফিসে উভয়েরই সমান সমান অবদান আছে। আছে আলাদা এবং স্বতন্ত্র ভূমিকা, বলতে বলতে উঠে বসে মিহির, স্বাধীন এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মধ্যেই যে যার ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করতে পারবে।
তাই বলে তোমরা পুরুষেরা, দিনের পর দিন মেয়েদের হেনস্থা করবে, মুখ বুজে সহ্য করে যাব?
সেকথা আমি বলি নি। বোঝাতে চেষ্টা করে মিহির, বিপিনবাবু আমাদের পিতৃস্থানীয়। অপত্য স্নেহে সে যদি কারও মাথায় হাত রাখে—
আগাছা প্রথম দিনেই বিনাশ করতে হয় বুঝলে, ফোঁস করে ওঠে চন্দ্রা, নইলে জঙ্গল হয়ে যায়। আজ মাথায় হাত রাখছে কাল বুকে হাত দেবেন পরশু…..
আহ! চন্দ্রা! অহংকার তোমাকে সীমানার অনেক বাইরে নিয়ে চলেছে। নিজের ওজন বুঝে চলার চেষ্টা করো— শাস্তি পাবে। বোঝায় মিহির।
উচিত কথা তো অহংকারের মতই শোনাবে। বেড সুইচ অফ করে দেয় চন্দ্রা। গাঢ় অন্ধকারে হঠাৎ ডুবে যায় সারা ঘরটা। মিহির বুঝতে পারে চন্দ্রা বালিশে মাথা রেখে বিছানায় গড়িয়ে দিয়েছে নিজেকে। কথা না বাড়িয়ে নিজেও টুক করে শুয়ে পড়ে চার পাশে রাখা বালিশে। এতক্ষণে ঘরে অন্ধকার একটু ফিকে করতে ঘুলঘুলির ফাঁক দিয়ে চুইয়ে এসেছে রাস্তার একচিলতে আলো।
তুমি কি চাও আমি ইউনিয়ন করা ছেড়ে দিই? ভীষণ গম্ভীর শোনায় চন্দ্রার গলা।
মোটেও না। সংক্ষিপ্ত জবাব মিহিরের।
তুমি চাইলেও আমি ছাড়তে পারবো না, কারণ প্রতিবাদ আমার রক্তে মিশে গেছে আপাতত যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম চলবে আন্দোলন চলবে। বিপিবাবুদের মত বুড়ো শয়তানদের বিরুদ্ধে। শক্ত টানটান গলায় ঘোষণা করে চন্দ্রা। কোন জবাব না দিয়ে পাশ ফিরে শোয় মিহির—অন্ধকারে নিজেকে ঢেকে।
কি হলো? সাড়া শব্দ দিচ্ছে না যে? মিহিরের পিঠে ঠেলা দেয় চন্দ্রা।
প্রকৃত কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইতে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু কোন ইলুউশনের পেছনে দৌড়ে কেউ যদি অফিসের ওয়ার্ক কালচার আর ডিসিপ্লিন নষ্ট করে।
ইউনিয়ন এ্যাকটিভিটি তোমার মতে ডিসিপ্লিন নষ্ট করা? আবার ফোঁস করে ওঠে চন্দ্রা।
আমি সে কথা বলিনি। ব্রফ গম্ভীর স্বরে জবাব দেয় মিহির। অফিসের ইস্যু অফিসেই সেটেল করা ভালো সংসারে এক বিছানায় শুয়ে নয়।
বেশ তাই হবে।
আমি বরং এখান থেকে ট্রান্সফার নিয়ে নিই, অনেকটা স্বগতোক্তির মত বলে মিহির, তাতে অন্তত তোমার আমার মধ্যে সাংসারিক শান্তি কবে।
এ্যাই। বাজে কথা বলবে না, আমি কোন অশান্তি করি নি।
বিপিনবাবুও সেই কথাই বলছিলেন—অগ্নিকন্যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা যায় সংসার করা যায় না।
কি? বিপিনবাবু আমাকে অগ্নিকন্যা বলেছে? মুখে ফুঁসে উঠলেও মনে মনে খুশি হয় চন্দ্রা। আর কোন কথা না বাড়িয়ে চুপ করে শুয়ে থাকে। ঘুম আসতে চায় না। হঠাৎ মনে পড়ে মৌমিতার কথা। মনটা কেমন খারাপ হয়ে যায়। মানসিক দুর্বলতাই যে কোন মনখারাপের কারণ। হঠাৎ চন্দ্রা বুঝতে পারে তার ভেতর একটা মা আছে—যে মা সন্তানের জন্য কাঁদে। বুঝতে পারে তার ভেতর একটা মেয়ে আছে, যে মেয়ে স্বামীর কোলে ভালবাসার তাপ পেয়ে পেয়ে পুড়ে যেতে চায়। ঘুম না আসা চোখ কড় কড় করে ওঠে চন্দ্রার—আর মিহির পরম শান্তিতে পাশে শুয়ে নাক ডাকিয়ে চলে ঘোতর ঘোতর
এ্যাই! ঘুমিয়ে পড়লে? মিহিরের গায়ে টোকা দিয়ে নিবিড় হতে চায় চন্দ্রা, কি গো? ঘুমুলে?
ইউনিয়ন আর ম্যানেজমেন্টের কচকচানি আমার একটুও ভালো লাগছে —আমার ঘুম পাচ্ছে…জড়ানো গলায় জবাব দেয় মিহির।
বাড়িতে এসব আলোচনা না করাই ভালো। কি বলো? চন্দ্রা তার ডান হাতটা দেয় মিহিরের শরীরে। রাগ হয়েছে? আমার দিকে ফিরবে না?
এই মুহূর্তে কি করা উচিত বুঝতে পারে না মিহির। চন্দ্রা যে দিন দিন অনেক অনেক দুরে সরে গেছে। এই পরিস্থিতিতে চার দিকে ফিরে চন্দ্রাকে জড়িয়ে ধরে আদর করলে যদি কোন অন্যায় হয়, হেনস্থা করা হয় অধস্তন কোন কর্মীকে। কারণ চন্দ্রা তো কেবলমাত্র তার স্ত্রী নয়, অফিসের একজন মহিলা টাইপিষ্টও বটে। পাশ ফিরে কাত হয়ে শুয়ে থাকা চন্দ্রাকে এক ঝলক দেখতে চেষ্টা করে মিহির— কিন্তু পারে না। ঘুলঘুলি দিয়ে চুইয়ে পড়া আলোয় সে জোর নেই যা অন্ধকারকে ঠেলে আপাত বিবাদমান দুটো মনকে একাকার করে দিতে পারে।