তাই চন্দ্রার কাছে এমন চাচাছোলা বুলি আশা করেনি মিহির। যতই ইউনিয়নের পাণ্ডা হোক না কেন সেকশন ম্যানেজারের স্ত্রী তো বটে। চন্দ্রার এই চাচাছোলা চরিত্র সেদিনের সেই একুশে মে মঙ্গলবারই উপলব্ধি করতে পেরেছিলো মিহির। কানুনগো সাহেবের ধমক খেয়ে পরদিন থেকে বন্ধ করে দিয়েছিলো অফিসে আসা। লজ্জায় অপমানে কয়েকদিন পরে রেজিষ্ট্রি পোষ্টে পাঠিয়ে দিয়েছিলো ইস্তফার অগ্রিম নোটিস। অন্য সহকর্মীদের পই পই বারনেও বিন্দুমাত্র বিচলিত হতে দেয় নি মনকে। অন্য একটাও চাকরীও পেয়ে গেছিলো কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসে-ধানবাদ খনি এলাকায়। কিন্তু বাদ সেধেছিলো চন্দ্রা নিজেই। অফিস ফেরত সন্ধ্যের সময় দুমদাম এসে সোজা ঢুকে গেছিলো ঠাকুর ঘরে-বিধবা মায়ের কোলের কাছে, ছেলেকে একটু শাসন করতে পারেন না। অফিসের বস কিনা কি বলেছে তাই চাকরি ছেড়ে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে হবে ঘরের কোণে?
তুলসীর মালা আর নামজপ ভুলে ফ্যালফ্যাল করে বাঁশি হাতে বসে থাকা গোপালের দিকে চোখ রেখে থাকা ছাড়া সেদিন কোন ভাষা জোটে নি বাল্যবিধবা মিহিরের মায়ের মুখে। পাশের ঘর থেকে সব শুনছিলো, সব দেখেছিলো মিহির। অনর্গল খই ফোঁটানো চন্দ্রার শাসানি কানের লতি গরম করে দিয়েছিলো সেদিন, জমিদারি থাকলে আমার কিছু বলার নেই। ছেলেকে ঘরে বসিয়ে বোতলে করে দুধ খাওয়ান। আর তা না থাকলে শাসন করুন, অফিসে যেতে বলুন। শেষের শব্দগুলো এখনও মিহিরের কানে ইলশে গুঁড়ির মত ঝিরঝির করে বাজে। কারণ চন্দ্রার গলায় তখন ছিলো দলা পাকানো অম্বলের মতো কান্না মেশানো তেজ। যা একমাত্র চন্দ্রাকেই মানায়।
কিরে খোকা মেয়েটা কি বলছে—তুলসীর মালা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলো মা। ততক্ষণে চন্দ্রা এসে টানটান থমকে পড়েছিলো মিহিরের সামনে লম্বা শরীরটা ঢেকে দিয়ে—অসভ্যের মত মেয়েদের দেখলে উপরওয়ালার বকুনি একশো বার খেতে হবে। কিন্তু কাল অফিসে না গেলে সারা পাড়ায় পোষ্টার লটকে দেব যে তুমি আমায় বিয়ে করতে চেয়েও কথা রাখ নি। বলে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে নি চন্দ্রা। হু হু করে চৌকাঠ পার হয়ে সোজা রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা রিক্সার বুকে নিজেকে সঁপে বিলীন হয়ে গেছিলো অন্ধকারের দেশে হিন্দি সিনেমাকেও হার মানিয়ে।
ফ্যাসাদ, বড় জ্বালা। হাজার চেষ্টা করেও মাকে বোঝাতে পারে নি মিহির। আর শেষ পর্যন্ত পুরানো অফিসে ফিরে আসতে হয়েছিলো কাজে। সবাই সেলিব্রেট করেছিলো ওর ফিরে আসা। এমন কি চন্দ্রাও। সময়ের ঢেউ ঠেলে অনেক কটা দিন পার হয়েছে ওদের জীবনে। মিহির ছুটছে ক্যারিয়ারের পেছন পেছন আর চন্দ্রাকে ছুটিয়েছে ইউনিয়ন। অফিসার হবার পর কর্মক্ষেত্রে যাতে দু’জনের সংঘাত ক্রমাগত দানা বেঁধে না ওঠে তার জন্য রানাঘাটে বদলির চেষ্টা করেছিলো মিহির–কিন্তু ম্যানেজমেন্ট মেনে নেয় নি।
ছিঃ চন্দ্রা তোমার মুখে একথা সাজে না, মৃদু অথচ দৃপ্ত হয়ে ওঠে মিহিরের গলার স্বর।
বিছানায় নতুন চাদর বিছানো ছেড়ে থমকে দাঁড়ায় চন্দ্রা কোন কথা?
অফিসার হবার খোটা, আয়নার সামনে গিয়ে চিরুনি তুলতে তুলতে বলে মিহির, তোমারই তো শখ ছিলো কানুনগো সাহেবের চেয়ারে আমাকে দেখার। বিপিন বাবু ঠিকই বলছিলো আজ…
কি বলছিলো বিপিনবাবু?ধনুকের ছিলার মত ভ্রু বাঁকায় চন্দ্রা, একটা আস্ত দালাল…
ভুলে যেও না বিপিনবাবু তোমার বাবার সহপাঠী ছিলেন।
ব্যাস-অমনি মাথা কিনেছেন কি? অসভ্য বেয়াদপ, দপ করে জ্বলে ওঠে চন্দ্রা, মেয়েদের গায়ে মা মা বলে হাত বোলান কি পিতৃস্নেহে….আমরা কি কিছুই বুঝিনা?
সুন্দরী মেয়েদের গায়ে হাত বোলাতে কোন পুরুষের না ইচ্ছা করে বলো? পরিস্থিতি এবং পরিবেশে হাল্কা প্রলেপ দিতে চায় মিহির।
ওসব ছেলেভুলানো কথা ছেড়ে আসল কথায় এসো, বিছানার উপর পাট-পাট চাদর ছড়াতে ছড়াতে বলে চন্দ্রা, কি বলছিলো বুড়ো ভামটা?
খারাপ কিছু বলে নি বিপিনবাবু। চেম্বারে বসে মিহিরও নিজের কানে শুনেছে আজ চন্দ্রার শ্লেষ ছড়ানো কথাগুলো। টিফিনের অবসরে মহিলা সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে চন্দ্রার বাণী ছিলো, সুপ্রিম কোর্ট কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের প্রতি হেনস্থা মানবাধিকার লঙঘন হিসাবে গণ্য হবে, পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েরা যাতে কর্মক্ষেত্রে কোন বৈষম্যের শিকার হয় সেজন্য সুস্থকাজের পরিবেশ তৈরি করতে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করাতে হবে কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতি বা বাড়তি সুযাগ সুবিধা পাওয়ার জন্য আমরা কোন মতেই যেন পুরুষ কর্তৃপক্ষকে হেনস্থা করার সুযোগ করে না দিই বন্ধুগণ ঠাট্টা ইয়ার্কির মাধ্যমে আমাদের উপরওয়ালারা যেন কোন মতেই কোন বৈষম্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে। আপনারা জানেন মিহির বোস আমার স্বামী তা সত্ত্বেও কর্মচারী বন্ধু এবং বান্ধবীদের সামগ্রিক কল্যাণে ন্যায় এবং স্বার্থরক্ষার লড়াইয়ে তার বিরুদ্ধেও আন্দোলন করতে আমি বিন্দুমাত্র পিছপা হই নি এবং ভবিষ্যতেও হবো না
তারপরেও আরও কি যেন বলতে চেয়েছিলো চন্দ্রা কিন্তু শোনা যায় নি—চটপটাপট হাততালির দৌলতে। হাততালি শেষ হবার পর যেটুকু শুনেছিলো তা হলো— প্রয়োজনে ঘরে এবং সংসারেও আমি প্রতিবাদের বন্যা বইয়ে দেব যদি আপনারা এবং আপনাদের সার্বিক সমর্থন আমার সাথে থাকে….