রাতের এই সময়টা বড় একান্ত সময়। চাকরির ঝনঝনানি নেই-কৌতূহল কোলাহলের হুল্লোড় নেই। বাস মোটরের হর্ণ নেই। ফাইল নেই। উপরওয়ালার হম্বি তম্বি নেই। ইউনিয়নের চলছে চলবে চিৎকার নেই। যা আছে তা হলো দুচারটে ঝি ঝি পোকার কি কি শব্দ। আর দু’জনকে দু’জনের নীরব চোখে দেখে নেওয়া। কিন্তু–
রাতের এই সময়টা বিছানায় আধশোয়া বসে সিগারেটের ধোঁয়া ছেয়ে ফুসফুস ভরাতে ভরাতে মিহির আজকাল বাসি খবরের কাগজের বুকে চোখ বুলায়। কয়েক বছর আগেও মিহির আধবোজা চোখে তারিয়ে তারিয়ে চার শরীর জোড়া খাজুরাহের শ্রাবন্তী খুঁজতো। এই সময়টা চন্দ্রারও একান্ত নিজস্ব ছিলো। একরাশ পোষাকের জঞ্জালমুক্ত দেহটাকে কোনমতে একটা সুরি পাতলা নাইটিতে জড়িয়ে একের পর এক প্রসাধনের প্রলেপ ঢেলে দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সাড়ে তিন ফুট আয়নার সামনে বসে থাকতো অনেকক্ষণ।
সংসারের টুকিটাকি কথাবার্তা বিনিময় করা ছাড়া এখন আর আগের মত কোন কথা বা গল্প খুঁজে পায় না ওরা। সংসার বলতে সাড়ে ছ’শো স্কোয়ার ফুট ফ্ল্যাটে মাত্র দু’জনের বসবাস। চন্দ্রা আর মিহির। মৌমিতা এখন আর ওদের কাছে থাকে না। কালিম্পঙের একটা স্কুলে এবছরই কেজি ওয়ানে ভর্তি হতে পেরেছে। গত মাসেই ওরা দেখে এসেছে বাবা-মাকে ছেড়ে এতটুকু মেয়ের হোস্টেলে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা।
মৌমিতার জন্য মাঝে মধ্যে মিহিরের মন খুব খারাপ হতো। এখন অনেকটা গা সওয়া হয়ে গেছে। চন্দ্রা রং তুলনায় অনেক কঠিন। মেয়েকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রথম সারিতে দাঁড় করাতে হবে-তাই অত মায়া দয়ার ধার ধারে না সে। আদর দিয়ে বাঁদর গড়ার চাইতে শাসন করে মানুষ গড়ে তোলাই তার একান্ত ইচ্ছে।
ভাল কথা! কাল আমাদের এসিকিউটিভ কমিটির মিটিং চুলের গোড়ায় ব্রাশ বোলাতে বোলাতে বলে চন্দ্রা, সুজাতাকে কিন্তু অযথা আটকে রেখো না।
ম্যানেজমেন্টের কাছ থেকে কোন স্পেশাল লাভের অর্ডার আসে নি। সিগারেটে শেষ টান দিতে দিতে বলে মিহির।
তোমরা খালি শিখেছ ম্যানেজমেন্ট আর অর্ডার। চুলের ব্রাশটাকে তর্জনীর মত উঁচিয়ে ধরে চন্দ্রা।
চন্দ্রা আর মিহির ফ্ল্যাটের এই ঘরটায় এখন এক ছাদের নীচে—ওরা স্বামী-স্ত্রী। গত এপ্রিল মাসে ওদের বিবাহিত জীবন নয় গড়িয়ে দশে পড়েছে। বস্ত্র দুয়েক আগেও দাম্পত্য জীবনের এই দিনটির কাহিনী নিয়ে হো হো করে রসিকতা করতো মিহির। বলতো, সাত বছ যে প্রেম করলাম সেটা বেমালুম উঠে যাবে? চন্দ্রা যুক্তি দিয়ে বোঝাতো, প্রেমের তো আর কোন লেখা জোখা তারিখ থাকে না। না থাক লেখা জোখা তারিখ, চন্দ্রা যেদিন কানুনগো সাহেবের কাছে তার বিরুদ্ধে নালিশ করেছিলো, সেটাই নাকি প্রেমের শুরু—মনে করে মিহির। একপাল আত্মীয়স্বজনের দঙ্গলে হঠাৎ লাজুক হয়ে ওঠা চন্দ্রার গলায় সাদা রজনীগন্ধার মালাটা টুক করে যেদিন পরিয়ে দিয়েছিলো, সেদিনের তারিখ মনে করতে এখনও সময় লাগে মিহিরের। কিন্তু কানুনগো সাহেবের কাছে বকুনি খাওয়ার তারিখটা তার জিভের আগায় সব সময় ভিড় করে থাকে–২১শে মে, মঙ্গলবার।
উফ! কি সাংঘাতিক। লাজুক লাজুক মেয়েটার বুকের ভেতর যে এমন তেজের আগ্নেয়গিরি ছিলো স্বপ্নেও সেদিন ভাবেনি মিহির। টাইপিস্টের কাজে নতুন যোগ দেওয়া মেয়েটার বসার টেবিল ছিলো ঠিক ওর সামনে। আর পাঁচ জোড়া কৌতূহলী চোখের মত মিহিরও চোখ মেলে দিয়েছিলো নবাগতা চন্দ্রা চৌধুরীর চালচলনের উপর। ব্যাস! তারপরই তুলকালাম। একুশে মে, মঙ্গলবার। মাত্র তিনদিনের কর্মচারী সারা অফিস দাপিয়ে মাথায় করে তুলেছিলো-বারুদ ফাটিয়েছিলো দুম করে কানুনগো সাহবের ঘরে। মিহিরের চোখে মনে বিন্দুমাত্র প্ররোচনা ছিলো না ছিলো না কোন আবেদন কিংবা নিবেদন। আর ভাগ্যি ভালো সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ তখনও দানা বাঁধে নি। তাছাড়া ভাল গোবেচারা ছেলে হিসাবে অপিসে একটা সুনাম ছিলো মিহিরের। তবুও হাতজোড় করে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়েছিলো পুঁচকে ঐ মেয়েটার কাছে।
আজ রীতাদি বলছিলো তুমি নাকি ওকে জেনারেল সেকসানে ট্রান্সফার করার হুমকি দিয়েছ? ড্রেসিং টেবিল ছেড়ে চন্দ্রা উঠে এসেছে বিছানার কাছে। উবু হয়ে বসে বক্স খাটের ড্রয়ার খুলে একে এক বের করে আনছে বালিশ মশারি।
না ব্যাপারটা ঠিক সে রকম নয়, বিছানা ছেড়ে নেমে এ্যাসট্রেতে সিগারেটের টুকরোটা চেপে ধরে মিহির, আসলে জেনারেল সেকসানে সিনিয়ার ক্লার্কের দরকার। তাছাড়া রীতা নন্দী একজন এফিসিয়েন্ট ওয়ার্কার।
এফিসিয়েন্সির নামে তোমাদের জারিজুরি সব আমার জানা আছে, ঝঝন করে বিছানার উপর পাতা বেড় শিটটা তুলতে তুলতে বলে চন্দ্রা।
আচ্ছা চন্দ্রা, তুমি মানে তোমরা কি চাও না অফিসের উন্নতি হোক….
থামো! তোমার গালভরা সব বকুনি। দু দিন আগে তুমিও তো ওদের মত হলঘরের কোনে বসে ফাইল আগলাতে। বদলে ফেলা বেডশিটটা ভাজ করতে করতে ধমকে ওঠে চন্দ্রা।
কথাটা অবশ্য মন্দ বলে নি। এই অফিসে মিহিরের প্রবেশ ইউ ডি ক্লার্কের বেশে। বছর পাঁচেক আগে মানব সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বিভাগীয় পরীক্ষায়। আজ অফিসের মালিক হয়ে বসতে পেরেছে। অফিসার হিসাবে কানুনগো সাহেবের চেয়েও নাকি মিহিরের দাপট অনেক অনেক বেশি। তাছাড়া ওর আমলে সারা অফিসের হাল হকিকতু বদলে গেছে। কলকাতায় যে অফিসের সবচেয়ে বেশি বদনাম ছিলো সেই অফিস গতবছর জাতীয় স্তরে প্রথম পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছে। কিন্তু সবটাই তো সম্ভব হয়েছে অলক্ষ্যে চন্দ্রার ভালোবাসায়, প্রশ্রয়ে আর নীরব উৎসাহে।