ক্লান্ত কণ্ঠে রকিবুল বলে : না। দিল হাসান বলেছিল আপনি নাকি জাদু জানেন। পুরুষ মানুষের বুকের দরজা খুলে দিতে পারেন।
: হ্যাঁ, জাদু জানি। তবে তাকে হতে হবে আমার প্রেমিক। আপনি তো তা নন।
: আপনার প্রেমিক কেউ আছে?
: আগে ছিল একজন। তাকে ছেড়ে দিতে হয়েছে। লোকটা খুব বদমেজাজী। আমার থেকে একশো পার্সেন্ট চায়। অথচ সে যে কি করে, কোথায় যায় তার কিছু আমাকে বলার প্রয়োজন বোধ করত না। কয়েকমাস আগে থেকে আমার বাসায় তার আসা বন্ধ। লোকটা খুব জেদী। আমি জানি না ডাকলে সে কখনো আমার কাছে আসবে না…..
: আপনি তাকে ডাকবেন?
: বুঝতে পারছি না। আমার কয়েকজন পুরুষ বন্ধু আছেন। তারা খুব বিবেচক। তবে কেন জানি না ঐ বদমেজাজী আর অসহ্য লোকটার সঙ্গেই আমার বেশ। মিলেছিল। লোকটাকে আর ডাকার ইচ্ছে আমার নেই। সে আমার ডাকের অপেক্ষায় নেইও। খবর নিয়ে দ্যাখেন একটার পর একটা মেয়েলোক উদ্ধার করে ফিরছে…খুব বাজে লোক।
জুলেখা একটু হাসে। বলে? মনে হয় আপনিও আমার মতো পুড়ছেন। আপনি হয়তো একটু বেশি। আপনাকে আসলে কোথায় যেতে হবে আপনি জানেন?
: হ্যাঁ জানি।
একটু পর রকিবুল জুলেখার ফ্ল্যাট থেকে ওঠে পড়ে। পৃথিবীতে কোন অভিজ্ঞতা ফেলনা নয়। জুলেখা খুব ভালো মহিলা।
.
৩.
তিনটি সেশান হয়ে যাওয়ার পর রকিবুল ও ডাক্তার সিদ্দিক উল্লাহর মধ্যে এরকম কিছু কথাবার্তা হয়েছিল?
: মহিলার কাছে কেন গিয়েছিলেন?
ও মনে হয় প্রলুব্ধ হয়ে। তবে প্রলোভন না হয়ে প্রয়োজনও হতে পারে। সে নাকি পুরুষ মানুষকে আনন্দের সাত দরজার ওপারে নিয়ে যেতে পারে।
: এটা ঠিক নয়। যারা এরকম বলে তারা হয় ব্যাপারটা বুঝে না, নতুবা বুঝেও আমোক আশ্বাস দেয়। হয়তো আপনার বন্ধু দিল হাসানেরই ভুল। ঠিক আছে, মহিলা যদি আপনার প্রেমিকা হয়ে উঠতে রাজি হয় তাহলে আপনি কি রাজি আছেন?
: না। আমার বয়স সাতচল্লিশ। আমার একটি ছেলে আছে। তাছাড়া স্ত্রীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক তো খারাপ নয়। যদিও সময় সে আমাকে বুঝে না অথবা আমি। তাকে বুঝতে পারি না…।
: ঠিক আছে তাহলে ঐ মহিলার কাছে গেলেন কেন? আপনার কি মনে হয়?
: প্রয়োজনে গিয়েছিলাম।
: আর একটু ব্যাখ্যা করতে পারেন?
: না। আর কিছু মনে আসছে না।
: নাদেরার ব্যাপারে আপনার একটা মমতা ও অপরাধ বোধ আছে একবার মধুখালিতে যান না কেন। গিয়ে মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক সহজ করে আসুন। অবশ্য যদি তার এখনকার স্বামীর অনুমতি মেলে। যাবেন?
: না। কোন কোন সম্পর্ক আর সহজ হয় না। যেমন ফিরে পাওয়া যায় না হারিয়ে যাওয়া সময়। তাছাড়া তেমন করতে গেলে আমার স্ত্রী খুব দুঃখ পাবেন। সেটা আমি চাই না…..
: বেশ তাহলে একটা কাজ করুন। আপনার স্ত্রীকে নাদেরা সম্পর্কে সব অনুভূতি খুলে বলুন….
: সে যে আমাকে ভুল বুঝবে ডাক্তার সাহেব।
: না। ভুল বুঝবে না। বরং আপনিও তাকে ইনভাইট করুন তার কোন না বলা কথা থাকলে বলতে। দেখবেন মনের ময়লা দূর হয়ে চমৎকার আন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরি হয়েছে…..
: আমি জানি না কি করব। রূপালী কোন কোন সময় খুব কঠিন মহিলা। তার কিছু কিছু ব্যাপার আমি বুঝতে পারি না।
: আর একটা কথা। নাদেরাকে একটা চিঠি লিখতে হবে।
ডাক্তার সিদ্দিক উল্লাহর সাথে আরো দুটি মেয়াদের পর কিছু ওষুধ ও ব্যবস্থাপত্র দিলেন তিনি। হাই অর্ডার অব ডিপ্রেশন। তিনি আশ্বাস দিলেন সব ঠিক হয়ে যাবে। রকিবুলকে মাস ছয়েক নিয়মিত মাসে দু’বার যেতে হবে তার কাছে। আনন্দের দরজা বন্ধ ঐ ডিপ্রেশনের কারণে।
কয়েকদিন খুব সতর্কভাবে ডাক্তারের নির্দেশ ফলো করে রকিবুল। এর মধ্যে একদিন টপ অব দা ক্লাবে পার্টি হয়ে গেল। মহা হৈ চৈ ও আমোদর্তি রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত। রকিবুল সহ্য করতে জানে বলে সবকিছুতে উৎরে যায়। তারপর রকিবুল আগের মতো সকাল বেলা স্নান সেরে পোশাক পরে তৈরি হয়ে অফিসে যায়, ফিরে আসে কখনো লাঞ্চের আগে এবং বেশির ভাগই বিকেল পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার দিকে। ডাক্তার যাই বলুক নাদেরাকে চিঠি লেখা যায় না, রুপালীকে বলা যা না তার সম্পর্কে সবকিছু ভাঙিয়ে। জীবন হল সহ্য করার ব্যাপার। দিন তো কেটে যায়। সময় ঠিকই যাবে। একদিন তার বাসায় গৌতম সাহা, দীদার আহমদ, সেলিম মীর্জা ও হাস্নাহেনা চৌধুরীর নিমন্ত্রণ। সাথে তাদের স্ত্রী ও স্বামী। রূপালী সবার সামনেই হাসতে হাসতে রকিবুলকে বলে যে যদি অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে তাহলে রকিবুল বরং তার অফিসে চলে যেতে পারে। তার কাছে তো কাজই হল জীবন।
রকিবুল বেঁচে যায়। ফিসে তার যাওয়ার ইচ্ছে নেই। সে চলে এল তার ছেলে মুহীবরের ঘরে। মুহীবরের বয়স সাত বছর। সে একটা রংয়ের বাক্স দিয়ে কাগজে রঙ-তুলির খেলা খেলছিল। রকিবুল তাকে জিজ্ঞেস করে : মুহী, তুমি কি বড় হয়ে আর্টিস্ট হতে চাও….
মুহী বলে? না। বড় হয়ে আমি আম্মুর মততা হতে চাই।
না, না, বলে তৎক্ষণাৎ ছেলেকে বুকের মধ্যে টেনে নেয় রকিবুল। তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠেছে। সে বলল : না।
হেনস্থা – তপনকুমার দাস
এ মাসের ফর্দে ওভার নাইট ক্রিম আর হেয়ার রিমুভার লেখার কথা ভুলো না কিন্তু। ওভারনাইট ক্রিমের একটা দলা হাতের তালুতে পিষতে পিষতে কথাগুলো ছুঁড়ে দেয় চন্দ্রা। প্রথম শীত্রে কচি ঠাণ্ডা ঘেরা থমথমে ঘরে শব্দগুলো ভাসতে ভাসতে এসে আছড়ে পড়ে মিহিরের কানে। কথা তো নয় আদেশ। রস কষ হীন নিরেট নির্দেশ।