কুহি সামনে বসে অবাক হয়ে প্রৌঢ় তবে শরীরে স্বাস্থ্যে বেশ মজবুত লোকটাকে দেখছিল। বারো মিনিটের মধ্যে একবারের জন্যেও চোখ তুলে তাকায়নি। একটা কথা বলেনি। ঘাড় গুঁজে বসে আছে সেই তখন থেকে। কুহি জানে মানুষ ভালো হয় না, মন্দ হয় না, সে ভালো-মন্দের মাঝখানে বাস করে বলে ভালো বা মন্দের কিংবা সুখ বা দুঃখের একটা ছাপ তখনকার মতো বহন করে। জেলখানার কয়েদীর পোশাকের মতো। তার আম্মা তাকে এসব কথা বলেছেন। ছোটবেলা দেখেছে, আম্মার একজনের বেশি সত্যিকারের ছেলে বন্ধু নেই। এখন হয়তো একাধিক বা অনেক বন্ধু তার থাকতে পারে। সে যাই হোক, আম্মা তার একমাত্র বন্ধু ও ভরসা। আম্মা খারাপ কিছু করতে পারেন না বলে তার বিশ্বাস। এই লোকটাকে দেখে কুহির মনে হতে থাকে সে খুব বিপদে পড়া। আম্মুর কাছে সাধারণত আসে ড্যাসিং পুশিং সব লোক, কেউ কেউ খুব সফল, তাদের সবারই তাকাবার, বসার, কথা বলার, হেসে ওঠার একটা আলাদা স্টাইল আছে। আম্মুর কাছে যারা আসে তারা বেশির ভাগ হয় প্রাণচঞ্চল, অস্থির, হাসিখুশি এমনকি একটু-আধটু রগচটা। এই লোকটা ঠিক তাদের মতো কেউ না।
কুহি আর থাকতে না পেরে বলে : আঙ্কেল, দু একটা কথা বলেন।
ভারী মধুর ভঙ্গি মেয়েটোর। আদুরে অথচ আত্মবিশ্বাসী। তাকে হঠাৎ ভালো লেগে যায় রকিবুলের। এরিকম মেয়ে যেন সংসারে অনেক থাকে, বড় হয়ে আমাদের। প্রিন্স চার্মিং মহীবুর হোসেন যেন তাদের কারুর দেখা পায় ও ডেটিং করে। রকিবুল মায়ার্দ্র হয়ে ভাবে। পরে তার মনে হয় এটা বোধহয় একটা বাড়াবাড়ি চিন্তা হয়ে গেল। মেয়েটাকে সে ভালো চেনেও না। এইমাত্র বুঝতে পারে যে কলেজের ফাস্ট ইয়ার বা সেকেণ্ড ইয়ারের ছাত্রী হবে। হয়তো সতেরোর মধ্যে বয়স। টিন এজার। একটা কথা শুনে বা কথার ভঙ্গি দেখে কোন উপসংহারে চলে যাওয়া নিশ্চয়ই ঠিক
: তুমি কোথায় পড়ছ, ইডেনে না বদরুন্নেসায়?
: জগন্নাথে। সেকেন্ড ইয়ার কমার্স।
: জগন্নাথে। আচ্ছা কমার্স! হুঁ।
আচ্ছা, হুঁ এইসব শব্দ বলেটলে রকিবুল হঠাৎ এক কাণ্ড করে বসে! জিজ্ঞেস করে ফেলে ও আচ্ছা বড় হয়ে তুমি কার মতো হতে চাও…..
তার জানার ইচ্ছে হচ্ছে বটে। বাবা খানদানী বংশের ও উচ্ছন্নে যাওয়া। মা মনে হয় শিক্ষিতা, রুচিবতী ও জীবনের অনেক দূর তৈরি হওয়া মানুষ। বু তাকে মডেল করা যায় কি? মেয়ের পক্ষে বলা যায়, আমি আম্মুর মতো হব? মুহীর যেমন বলে, আমি আবুর মতো হব? রকিবুলের খুব জানতে ইচ্ছে করছিল।
কথাটা শুনে কুহি একটু হকচকিয়ে গেল না? হা করে তাকিয়ে রকিবুলের দিকে। এসময় ট্রেতে নাস্তা ও চা নিয়ে ঘরে ঢোকে জুলেখা। হ্যাঁ, কেশবতী বটে। আর মাথায় অনেকটা লম্বা। এর মধ্যে ভেতরে গিয়ে একদম কোন সাজগোজ করেনি। ঠোঁটে লিপস্টিকের ছোঁয়া পর্যন্ত না। ‘একটু দেরি হয়ে গেল, না’, বলে হাসতে হাসতে রুপালী মহিলা টেবিলে ট্রে নামিয়ে রাখে। কুহি ‘আমি যাই’ বলে ওঠে পড়েছিল। তাকে জুলেখা বলে যে এখন বাইরে যাওয়া চলবে না, হোমটাস্ক বাকি, লাঞ্চের আগে সেগুলো শেষ করতে হবে। খুব মেজাজ দেখিয়ে কুহি বলে? উঃ অসহ্য। মা মেয়ে হাসছিল পরস্পরের দিকে তাকিয়ে। ‘কুহি যাই আঙ্কেল’ বলে আদাব দিয়ে চলে যায়। রকিবুলের মনে হতে থাকে তার একটু একটু ভালো লাগছে।
এরপর চা খেতে খেতে দু’জনের মধ্যে কুশল বিনিময়। আপনার দেশ কোথায়? ব্যবসা কেমন চলছে? আপনার হাব্যান্ড কি ঢাকায় না বাইরে? দিল হাসান আপনার প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ। আপনার স্ত্রী কিছু করেন-টরেন? ছেলেমেয়ে? এসব নিয়ে আলাপচারিতা। এছাড়া এর ওর দিকে তাকানো-টাকানো। হাসা টাসা বা হাতনাড়া, কপাল ঘষা ইত্যাদি। রকিবুল হোসেন একটু প্রখ করে দ্যাখে মহিলার ওয়েস্টলাইন এখনো দারুণ ভালো। সন্দেহ নেই, মেইনটেইন করেন। নতুবা বয়স তো চল্লিশের কাছাকাছি নিশ্চই। জুলেখা দ্যাখে ভদ্রলোকের বেশ পুরুধু মুখে থুতনির দিকটায় একটু টিপে দেওয়া খাঁজ। নাকে ঘাম জমে। চোখ দুটি জ্বলে পড়ে খাক হয়ে আছে। ভেতরে ভেতরে লাজুক বোধহয়। পৃথিবীর বেশির ভাগ অনর্থ ও ভালো কাজ ভেতরে ভেতরে লাজুক এই পুরুষেরাই করেছে।
সাধারণ আলাপচারিতার পরে বেশ কিছুক্ষণ ওরা চুপচাপ। জুলেখা ভাবছিল বলুক। সে তো কিছু বলতেই এসেছে। রকিবুলের মনে হতে থাকে তার তো বলার বিশেষ কিছু নেই। জুলেখাই বলুক না। বড় আশা নিয়ে সে এসে পৌঁছেছে এপার্টমেন্ট হাইজিংয়ের দশতলায় দিল হাসানের জীবনের অভিজ্ঞতা হল, সব নারী পুরুষের ওপর জাদু কেলতে জানে। কম বা বেশি। জুলেখা একটু বেশি জানে। সেই জানা প্রয়োগ করুন রকিবুলের ওপর।
জুলেখা চট করে কিছু বলল না। একটু শিথিল হয়ে বসে। যাতে তার গলার ছাঁট, বুকের নিচে অনকেদুর নেমে যাওয়া ও কোমরের কিছু অংশ চোখে পড়ে। যে কোন নারী যৌবনে নিজেকে যতটা পারুদঘাটিত করতে চায়। জুলেখা তার ব্যতিক্রম হবে কেন। তবে রকিবুল শরীরের ঐ দেখানো-অংশে মোটে তাকাচ্ছিল না। সে সবসময় নারীকে চেনার ও বুঝার জন্য বেছে নেয় তার চোখ। জুলেখার চোখ কিছু অসাধারণ নয়। তবে একটা কথা হল, সেই চোখে জীবনে অনেক কিছু দেখার ছাপ। ছিল।
একটি ফিসফিসে গলায় জুলেখা বলে : কেন এসেছে আমার কাছে? সম্পর্ক করতে চান?