জুলেখার মেয়ে কুহি ও রকিবুল মুখোমুখি বসে আছে। তার কথা বলার তেমন ইচ্ছে নেই। কুহি মেয়েটা বেশ ভদ্র বলে মনে হয়। সে হয়তো ভাবছে এই আঙ্কেল এমন গভীর কেন। রকিবুল কুহির সামনে বসে আছে, মাঝে-মধ্যে চলে যাচ্ছিল আচ্ছন্নের মধ্যে। সে একটা কথা খুব জানে যে, যোগ্য না হলে কেউ এ্যাঙ্গুর ওঠে আসতে পারে না। মধুখালি একটা আধা গ্রাম আধা শহর। লোকেরা কাঁধে গামছা ফেলে খালি গায়ে নদীতে গোসল করতে যায়। রাস্তার পাশে পাটি বা সতরঞ্চি ফেলে তার ওপর বসে ছুটির দিনে তাস খেলা মানুষজন ভাবনা-চিন্তা করে খুব কম। তারা হয় ভালো গোছের ও অলস। ১৯৬৩ সালের দিকে যেবার মধুখালিতে বিদ্যুৎ গেল, সেবার যার যার বাড়িতে বিদ্যুৎ আছে, তারাই বেশ ডাটের মানুষ বলে পরিচিত হয়েছিল। না, ডাটের মানুষ না, আধুনিক মানুষ শুদ্ধ করে বললে মডার্ন। এইরকম একটা আধা-শহর আধা গ্রাম থেকে ঢাকার জি. ও. এইচ. এসের ঝকঝকে সুন্দর দোতলা বাড়িতে ওঠে আসতে পারা যোগ্যতার ব্যাপার নিশ্চয়ই। হয়তো মধুখালি লোক নাদেরার কথা ভেবে বলবে যে তাহলে রকিবুল মিঞা, এম, এ পরীক্ষাটা পাস করতে না করতে হুট করে বিয়ে করার কি দরকার ছিল। মধুখালির মানুষ এটা বলতে পারে। এই রকম বলতে পারার হক তাদের আছে। নাদেরা ও রকিবুল ছিল একই পাড়ার ছেলেমেয়ে। তাদের বাড়ি থেকে ব্ৰহ্মপুত্ৰ এক চীৎকারের পথ। কিছুদূর গেলে শহর শেষ হয়ে যায়, তারপর ঝোঁপঝাড়ের পথ ঠেলে শুধু নদীর পাড়। স্কুলে পড়ার সময় থেকে নাদেরা ও রকিবুলকে মধুখালির মানুষ নদীর পাড় ধরে হাঁটতে দেখেছে, নদীতে যার যার সঙ্গী-সাথী নিয়ে মানে যেতে দেখেছে। তবে সবাই তো জানে দুই দলে কে কৃষ্ণ, কে রাধা। মধুখালিতে সেই বিশ বছর, তিরিশ বছর আগের কথা, মানুষের জীবন ছিল মানুষের কাছে মুখস্থ। কাজেই নাদেরাকে বিয়ে করা বিয়ে করে বছ দুই পর ঢাকা চলে আসা, দুমাস, চার মাস পর এক-আধ দিনের জন্য মধুখালিতে যাওয়া, শেষে নাদেরার অসুস্থ হয়ে যাওয়া, রকিবুলের খুব বেশি রকম ঢাকামুখী হয়ে যাওয়া, এসব নিয়ে মধুখালির লোক কথা বলার হক রাখে। তারা বলতেই পারে।
বিশ বছর পঁচিশ বছর আগের মধুখালি ছিল কিছুটা শহর তবে অনেকটাই গ্রাম। সেখানকার মানুষ নিজের বৈঠকখানাকে আমার বৈঠকখানা বলে না, বলে আমগোর বৈঠকখানা। জামাই, কবে আসলেন?’ এই কথা জিজ্ঞেস করত নাদেরাকে নিয়ে পাড়ায় বের হলে নাদেরাদের পাড়া-প্রতিবেশীরা। যে কারুর বৈঠকখানা ঘরে পাড়ার যে কারুর মেহমান এসে রাতে থাকতে পারত। এই ছিল মধুখালি। যেন পৃথিবীর ওপারে আরেক সভ্যতা। কমলাপুরের কাছাকাছি হয়ে কোথাও রেলের বাঁশি শুনলে মধুখালিকে কিংবা বৃষ্টিতে লক্ষকোটি সুচ ভাঙার শব্দেমুখর নদ ব্রহ্মপুত্রের ধারে সেই কুয়াশাধূসর মদুখালিকে। এও ভাবে রকিবুল, যোগ্যতা না থাকলে এ্যাদুর কেউ ওঠে। আসতে পারে না। হ্যাঁ, মধ্যে ঘটনা আর ব্যাপার স্যাপার আছে। যেমন, নাদেরার সঙ্গে তালাক হয়ে যাওয়া। ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ঘোর সন্দেহে পড়া যে রকিবুল তার হিস্যা হিসাবের মারপ্যাচে মেরে দিয়েছে। ফুল খালাম্মার মনে খুব দুঃখ দেওয়া। মহিলা বলতেন যে রকিব আমার পেটের ছেলে।
ব্যাঙ্কের কোলেটারেলের জন্য পুরানো পল্টনের জমি ও বাড়ির দলিল দিয়েছিলেন তিনি রকিবুলকে। এইসব বৃত্তান্ত আছে তার এ্যাদূর উঠে আসার মধ্যে। রকিবুল অনুতপ্ত কিনা? তা জেনে মানুষের কি লাভ! রকিবুল সেসব কখনো ভাবতে চায় না। সে চায় ভাবতে যে সে রকিবুল হোসেন, জি.ও এইচ, এসের শেষ পশ্চিমে ছিমছাম সুন্দর একটা বাড়ির মালিক। সেনা কল্যাণে এখনে স্পেস নেওয়া যায়নি বটে, তবে দিলকুশায় তার সাড়ে চার হাজার স্কোয়ার ফুটের অফিসও বেশ সুন্দর সাজানো গোছানো। স্মার্ট, মডার্ণ। বহুদিন মার খেতে খেতে এখন সে ব্যবসা শিখে গেছে, এখন সে দু’বার মার খায় তো পাঁচবার মার দেয়। ঢাকায় মাঝারি গোছের ট্রেডারদের মধ্যে সে নিশ্চিত দশজনের একজন বলে গণ্য হতে পারে। মধুখালি ইজ অলরাইট। তবে তার ছেলে আছে, অতীত নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি সে চায় না। সে নিজের মধ্যে দেখতে চায় দৈত্যের মতো নির্মম ও দেবতার মত সহৃদয় একটি মানুষকে। যে-কোন সফল মানুষ হল এইরকম, একই সাথে দৈত্য ও দেবতা বা ফেরেশতা। রকিবুলের ওপরে ওঠা এখনো বেশ অনেকটা বাকি। এই সময় কি বিপদ ও দুর্বিপাক যে বুকের ভেতরকার আনন্দের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে। কোন মানে হয়! বন্ধ হয়ে গেছে বৈকি! তার ছেলে নার্সারী ওয়ানের ছাত্র। সেন্ট জোসেফে। টিচার লিখে পাঠিয়েছে মুহীবর ডিড এক্সিলেন্ট ইন ক্লাস ম্যানারস। কি চমৎকার সংবাদ। মনের মধ্যে আনন্দের হু হু বাতাস বয়ে যাওয়া উচিত ছিল না? কিন্তু টিচারের লেখা দেখে রকিবুল শুধু একটু জোর দিয়ে মুহীবরকে বলেছিল ও গুড। ভেতর থেকে হেলে পড়া দেবে যাওয়া ভেঙে পড়া এই সমস্ত কি জিনিস? এতদিন তেমন গা করেনি। ইদানীং রূপালী যখন তখন জিজ্ঞেশ করে বসে, তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? পরশুদিন অফিসে দিল হাসান ও হরিপদ’র সামনে ওভার টেলিফোনে সাড়ে বাষট্টি লাখ টাকার অচিন্তনীয় একা সুসংবাদ পেয়েও তক্ষুণি উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠতে পারল না। এসব কি শরীর ও ক্যারিয়ারের জন্য খুবই খারাপ লক্ষণ না? তার একা নিরাময়ের দরকার। এই মহিলাটা নাকি জানে। দিল হাসানের প্রেসক্রিপশন। দেখা যাক।