রূপালী একটু চেঁচিয়ে বলে : এ্যাই, তোমার কি খারাপ লাগছে। শুনে একটু ভয় পেয়ে সংযত ও সতর্ক হয় রকিবুল। সাভার না গিয়ে ফিরে আসে বাসায় হাসি খুশি ভাব দেখাতে তো কোন অসুবিধে নেই, রুপালীকে সেই তৈরি করা চেহারা দেখিয়ে যাচ্ছি সে। তাতেও রূপালীর সন্দেহ কাটছে না দেখে রাতে খাওয়ার পর টেলিভিশনে কিছু একটা কতক্ষণ দেখাটেখার পর শোবার ঘরে গিয়ে রকিবুল বলে? আচ্ছা রূপূ, তোমার কাছে কোন্টা বেশি দামী, স্বামীর চুমু না টাকা?
: এ আবার জিজ্ঞেস করতে হয়। স্বামীর টাকা।
: বেশ আমি তোমাকে টাকা দিতে চাই। একটা শর্ত আছে।
খেলা বা মজা সব স্ত্রী মন দিয়ে বুঝে এবং খুব পছন্দ করে। রূপালী বেশ আমোদ পাচ্ছিল। তার এখন শাড়ি ছেড়ে নাইটি পরার সময়ে। মুখ থেকে রং তুলে ঠাণ্ডা পানি দিতে থাকবে। বিছানায় উঠে আসার আগে বিজ্ঞাপনের সুখী রমণীদের মতো টেবিল ল্যাম্পের চোরা আলোর নিচে বসে ওভাকন খেয়ে নেবে। রকিবুলের কথা শুনে মজা পেয়ে বলল : কি শর্ত স্যার?
: খুব মন খুলে হাসতে হবে। একেবারে ভেতর থেকে। একেবারে খুব ভের থেকে। বুঝলে তো? জিনিসটা করতে পারলে ড্রয়ারের যা কিছু ক্যাশ আছে, সব তোমার।
: সত্যি?
: হ্যাঁ, সত্যি।
: ঠিক বলছ?
: ঠিক বলছি!
রূপালী শক্তিশালী নারী বটে। হাসিতে-খুশিতে ঝর্ণার মতো অবিরল বাজতে থাকে পার্টনার বন্ধুর বাসায় সেই যে প্রথম দেখা হয়েছিল তার সাথে রকিবুলের উনচল্লিশ ও রূপালীর সাতাশ বছর বয়সে তেমনি কিছু বদলায়নি, সেই সুন্দর বুজলতা হয়ে আছে এখনো। জীবনের ওপরে ওঠার সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে কত হৃদয় আপোসে বদলে গেল। খবরের কাগজে কত কত হেডলাইন তৈরি হল ভেঙে যাওয়া, ধ্বংস হয়ে যাওয়া, মিসমার হয়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে। ব্ৰহ্মপুত্র, পদ্মা, যমুনা প্রভৃতি বিখ্যাত ধ্ব নদী তো প্রায় শুকিয়ে এসেছে। আল্লাহকে অশেষ ধন্যবাদ, রুপালী তেমন ফুরায়নি। ব ক্যাশ দিয়ে দেওয়া হবে শুনে নিশ্চয়ই নয়, রুপালী হাসছিল অশেষ আনন্দের ঝর্ণায় ঘা পড়েছে বলে। সে ধরতে চাইছে রকিবুলের একটু আগে ঘোষণা করা একটা বাজি। যেমন আজ থেকে বিশ বছর আগে রকিবুল, হাসান ও শিরীষ নষ্টচন্দ্রের রাতে মাঠ পাড়ি দিয়ে আকাশে ভাসতে থাকা, প্রত্যেকটা সময় মাত্র পাঁচ হাত দূরের একটা চাঁদ ধরতে চেয়েছিল। রকিবুল অভিভূত হয়ে যাচ্ছিল রূপালীর খিল খিল করে বেজে ওঠা হাসি শুনে। সেই যে একদা মধুখালির নাদেরার পছন্দ ছিল রকিবুলের একেক সময় দৈর্যে মতো হো হো করে হেসে ওঠাটা, সেই রকমেরই আনন্দ-খনি থেকে আপসে আপ উছলে ওঠা ঝঙ্কৃত ও চীৎকৃত হাসি। রকিবুল আজকাল আর কেন যেন পারে না। কিছুদিন আগেও কিছু না কিছু পারত। আর কি তাহলে ভেতরে সেই খনির দরজা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল?
ড্রয়ার খুলে ক্যাশ বার করে আনে রকিবুল, তখন নিজেকে দেখতে পায় রূপালীর আলিঙ্গনে ও চুমুতে বদ্ধ। চুমুকে চুমুতে ভরিয়ে দিয়ে বলছিল যে টাকা না, স্বামীর চুমু চাই। তখনো হাসছিল। অপারগ ও অসমর্থ রকিবুল সেই মুহূর্তে ঠিক করে ফেলে আর দেরি না করে এই ব্যাধির চিকিৎসা করবে, সম্ভব হলে আগামীকালই যাবে দিল হাসানের সেই মহিলার কাছে। ভেতরের দরজা বন্ধ হয়ে আসছে, আর দেরি করা যায় না।
২.
দিল হাসান টেলিফোন করে রেখেছিল। একদিন সুবিধে মতে, সোয়া বারোটার দিকে হাউজিং এপার্টমেন্টের একটা বাড়িতে মহিলার কাছে পৌঁছে গেল সে। দশতলায় দুইরুমের একটা ফ্ল্যাট। জুলেখাই দরজা খুলে দিয়ে তাকে হেসে স্লামালাইকুম জানায়। কেশবতী বটে। চুল একটু পীত বর্ণের তবে যত্ন করা, নরম ও মসৃণ, সাদাটে একটা ঝলক ফেলে নেমে গেছে কোমর পর্যন্ত। ফর্সা। খুবই ফর্সা। ফলে দাঁত তেমন ঝকঝকে নয়, যদিও লম্বা কাঠামোর মধ্যে শরীর বেশ মজবুত। এই মহিলার হওয়া উচিত ছিল কূটনীতিকের কিংবা কোন সচিবের স্ত্রী। মানুষ যে কতভাবে ভিন্ন দরজায় পৌঁছে যায়।
মহিলা তাকে বসতে বলে ভেতরে চলে যায়। একটু পর ভেতর থেকে এক কিশোরী এসে তাকে আদাব দেয়। জুলেখার মেয়ে। জানায় আম্মুর আসতে সামান্য দেরি হবে। আঙ্কেল যেন কিছু মনে না করেন।
রকিবুলের কথা বলার তেমন ইচ্ছে নেই। মেয়েটির মুখোমুখি চুপচাপ বসে থাকে। আজ অনেকদূর যাওয়ার জন্য মনে মনে তৈরি হয়ে এসেছে। লু যদি বুকের দরজাটা খোলে। মদ্যপানের অভ্যেস তার তেমন নেই, দরকার হলে আজ দু’এক পাত্র চালাবে। দিল হাসান বলে দিয়েছে : সে যা কিছু করতে বলে, করিস, দেখবি মজা আসছে। আরো বলে দিয়েছে, তাড়াহুড়া না করতে। জুলেখা মানুষের মনকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দেয়। সে ছিলো খানদানী ঘরের এক লোকের স্ত্রী। কিন্তু হলে কি হয়, লোকটা নিজে মহিলাদের ধরে রাখতে জানে না, আবার খুব বদমেজাজী, বদমাশও কি কম, নিজের সুবিধের জন্য দরকার হলে বৌকে ব্যবহার করত। একাত্তর সনে একজন পাকিস্থানী কর্নেল ও দু’জন মেজরকে এই জুলেখার টোপ দিয়ে সে গেঁথেছিল। উর্দু জানা বংশে আছে, কাজেই মেলামেশায় সুবিধে হয়েছিল লোকগুলোর, জুলেখার একাত্তর টা ওরাই তছনছ করে দিয়ে গেছে। দিল হাসান নিজে হাফ বাঙালি। কলকাত্তাইয়া। সে রকিবুলকে বলে দিয়েছে সাবধানে জুলেখাকে ব্যবহার করতে। কারণ মন ঠিকঠাক না হওয়া পর্যন্ত সে তোমার সাথে ড্রয়িংরুমের সোফা ছেড়ে শোবার ঘরে যাবে না। তবে হ্যাঁ, বাঘিনীর জাত। একবার মনে ধরে গেলে সে তার পুরুষকে আনন্দের সাত দরজা পার করে তুলে নিয়ে যাবে। জুলেখা তা পারে বলেই তো সে জুলেখা।