তার গাড়ি বিজয় প্রণির উপান্তে এসে লাল সিগনেল পেয়ে থেমে আছে। অফিসে বসে দিল হাসান ও সে কত চেষ্টা করেছিল। হৃদয় নিয়ে কিছুতে জেগে উঠতে পারছিল না। ভেতর থেকে আপসে আপ আসতে চায় না। দিল হাসান তবু বেশ ভালো আছে তার প্রিয় ক্রীড়া নিয়ে। জুলেখা এখন তার লেটেস্ট। সে জুলেখার চুলের বর্ণনা দেওয়ার সময় মনের কিছু কিছু মণিমুক্তো তুলে আনতে পারছিল। একদিক দিয়ে এটা ভালোই। এরকম কিছু একটাতে লেগে লেগে কেমন হয় ভাবতে থাকল সে।
নাদেরার সময় সে কি খুব সপ্রাণ, খুব জাগ্রত ছিল না? হ্যাঁ, খুবই ছিল। তখন রকিবুলের একহারা শরীর। কম বয়সে স্বাই হয়তো ভেতর থেকে সপ্রাণ ও সজীব থাকে। তার বয়স ছিল পঁচিশের কাছাকাছি। নাদেরার বাইশ। নাদেরার মুখ একটু লম্বাটে, পুজ অর্থপূর্ণ ছিল। রকিবুলের কারণে-অকারণে হঠাৎ একেক সময় দৈতের মতো হো হো করে হেসে ওঠা তার খুব পছন্দ ছিল। নাদেরা কখনো কখনো রকিবুলের বুকে মাথা রেখে বুকে মাথা ঘষতে ঘষতে বলত যে, আমি আর কিছু চাই না। সে অনেকদিন আগের কথা। আজও ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর ঝাঁঝরে পড়া বৃষ্টির কথা ভোলা যায় না। আহ্, কী সুন্দর তখন হৃদয়কথা বলে উঠত। পাখি বা নদীর জল যেমন করে কথা বলে ওঠে। তখন, এমনকি এর বহু পরেও, এই তো কিছুদিন আগেও বুঝা যেত বুকের ভেতরে একটা ঝরঝর ঝর্ণা আছে। আনন্দ। একটা গাছে পাতার আড়ালে দশ লাখ একাশি হাজার ফুলের ফুটে থাকা বা ওরকমই কোন ব্যাপার। আহ কি দুর্দান্ত সেই থাকাটা।
তার ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছিল। দোতলার কার্নিশের পরে নুয়ে পড়া গাছগাছালি পাশে তার ঘর। দখিনের শেষ। ঘরটা ছেলের জন্য সে-ই পছন্দ করেছে। যোক এতটুকু ছেলে। তাকে নির্দয় সংসারে আস্তে আস্তে একটা পুরুষ মানুষ হয়ে উঠতে হবে। একাল ঘরে থেকে অভ্যস্ত হওয়া দরকার আছে বলে সে মনে করে।
গিয়ে দেখে মুহীবর ঘুমুচ্ছে। চিৎ হয়ে শুয়ে। দু’হাত ছড়ানো। হাতের কাছে একটা ভোলা বই। অর্থাৎ আল্পর মতো ঘুমুবার আগে বই বা ম্যাগাজিন দেখার অভ্যেস করছে সে। মুহীবরেরটা ছিল নীল পরীর গল্প, রূপকথার বই। মুহীবর আব্দুর মতো হতে চায়। রবুিলের চালাবার প্রিয় গাড়ি হালকা গোলাপী করোলা এক্সেল। মুহীবরের ট্রাই সাইকেলের রং হালকা গোলাপীর কাছাকাছি ঘিয়ে রঙ। রকিবুল রূপালীর মতো কফি খেতে ভালবাসে না। তার প্রিয় পানীয় অবশ্যই চা, সেটা হতে হবে ফ্রেশ ব্লেন্ডিং, দার্জিলিং বা সিলেটের। মুহীবরও তাকে দিতে বলে : চা। রূপালী ধমক দেয় আর বলে ইশ, আব্বর মতো হবে, তোর আব্বর মতো হব। রূপালী হাসতে থাকে আর বলে তোর আবু কার মতো হতে চায় জিজ্ঞেস করে দ্যাখতো।
ছেলেকে দেখে তার ভেতর থেকে চুপসে যাওয়াটার কিছু উপসম হয়। যদিও খচখচ করে একটা কাঁটা বিধছেই। খাওয়ার টেবিলে সুস্থ সমস্ত গৃহকর্তার মতো বসে সে চিংড়িভর্তা দিয়ে একটুখানি ভাত মাখিয়ে নিয়ে স্ত্রীকে বলল। বলতে পারছিল সহজভাবে। এতক্ষণে সে একটু একটু এনজয় করতে পারছে প্রায় হঠাৎ পড়ে পাওয়া একটা বড় টাকার সুখ। আহ্, যদি দুর্দম খুশি হয়ে উঠতে পারত। পারছে না যে কেন। তবে সবুজ শাড়ি ও লাল জামা পরে আছে। বাইরে কোথাও যাক না যাক, সব সময় মুখে রং-চং মাখা চাই। কথাটা শুনে রূপালী বলে : সত্যি! তার এই সত্যি বলার মধ্যে প্রচুর আগ্রহ উৎসাহ-আনন্দ ইত্যাদি ছিল। হাসছিল রকিবুলের দিকে তাকিয়ে। না, এই হাসি ধার করা বা দিল হাসানেরটার মতো ঈর্ষায় কিছুটা জ্বলে-পুড়ে থাক হওয়া নয়। সহজ-সুন্দর হাসি। রকিবুলের আবার মন খারাপ হয়ে যায়। আমি যে কেন পারছি না। সে চিকেন ও সবজির ফালি দিয়ে কোরিয়ান স্টাইলে রূপালীর রাঁধা ডালের বাটিতে অনেকক্ষণ ধরে চুমু দিতে থাকে। একটু একটু। কখনো ঠোঁট ছোয় কি ছোঁয় না। শেষে তার হাবভাব দেখে তোমার কি খারাপ লাগছে, রূপালী এই ভয়ঙ্কর প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে বসে।
আজ একটা ভালো দিন। সাড়ে বাষট্টি লাখ টাকার প্রায় আশা ছেড়ে দেওয়া একটা বিল উদ্ধার করা গেছে। একটু এনজয় করা যাক ভেবে সে তার ঝকঝকে সুন্দরী স্ত্রীও প্রিয় দশ ছেলেকে নিয়ে বেরোল প্রিয় করোলা এক্সেলে। ডি. ও. এইচ. এসের প্রসারিত পশ্চিম জুড়ে তার সুন্দর ছিমছাম দোতলা বাড়ি। ছাতের কিছু টালি দেওয়া ইতালীয়ান মার্বেল পাথরের সিঁড়ি। কাঠের কারুকাজ করা দরজা। তার এই বাড়ি, মাস্টারির চাকরি থেকে ধীরে ধীরে ঢাকার মাঝারি ধরনের বেশ স্বচ্ছন্দ অবস্থার ট্রেডার হয়ে ওঠা, স্ত্রী ও ছেলে নিয়ে সংসারে থিতু হওয়া ইত্যাদি যোগ করলে দাঁড়ায় একটি গর্ব, একটি অহংকার : রকিবুল হোসেন। হ্যাঁ, নিচে থেকে ওঠে এসেছে বটে। মফস্বলে ছিল, গরিব গেরস্থ বাপের ব্যাকগ্রাউন্ড আছে, ঢাকা এসে আগামসিহ লেনের ধসে পড়া একটি ভাড়া বাড়িতে থাকত, ইত্যাদি। সবই ঠিক আছে। তবে যাই বল, রকিবুল যে হয়ে উঠেছে, এও তো সত্যি কথা। হয়ে ওঠাই বড় কথা। নয়?
কোথায় যাওয়া যায়, স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে। রূপালী বলে যে অনেকদিন গৌতমদার ওখানে যাওয়া হয়নি, গেলে কেমন হয়? অথবা দীদার চাচার ওখানে যাওয়া যায়, টিংকু নাকি স্টেটসে চলে যাচ্ছে! রকিবুলরা কোথাও স্থির করতে না পারলে ক্লাবে যায়। গাড়ি যাচ্ছিল সাভারের দিকে। ঘিয়ে রঙের রোদ ধরে আছে মাথা উঁচু সব গাছপালা। এছাড়া বিল থেকে জলজ উদ্ভিদের ঘ্রাণ মেশা হু হু বাতাস পাওয়া যাচ্ছিল। মুহীবব, খুব এনজয় করছিল। সে ক্রমাগত তার আন্ধুকে জিজ্ঞেস করছিল ব্যাটম্যান নাকি দেড়শ তলা ছাত থেকে পড়ে মারা গেছে? সুপারম্যান কি শেষ পর্যন্ত মার্সের কালো মুখোশ পরা শয়তান চক্রকে খতম করে দিতে পারবে? দোলন বলছিল যে আর দেড়শ বছর পর নাকি দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে। ইত্যাদি। রকিবুল উত্তর দেয় আর ফাঁকে ফাঁকে একটা মাঠের ছবি দ্যাখে। একটা মফস্বল শহর থেকে মাইল দুই দূরে নির্জন কতকগুলো শিমুল গাছ। তারপর মাইলের পর মাইল জুড়ে সেই মাঠ। একবার নষ্টচন্দ্রের রাতে এই মাঠে নেমে গিয়েছিল রকিবুল, হাসানুজ্জামান ও শিরীষ চন্দ। তারা তিন বন্ধু। হাসানুজ্জামান এখন মধুখালি উচ্চ বিদ্যালয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মাস্টার। শিরীষ চন্দ যে কোথায়, ইন্ডিয়ার কোন শহরে বা গ্রামে নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু কোথায় যে! রকিবুল ছেলেকে উত্তর দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে সেই একটা মাঠের ছবি দেখছিল। চাঁদ ছিল আকাশ জোড়া। সেই চাঁদের উদ্দেশে নষ্টচন্দ্রে রাতে রওনা হয়েছিল তারা নি বন্ধু হাসান, শিরীষ ও সে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে। হু হু করে হাওয়া। আর গোল চাদটা ঠিক চোখের সামনে পাঁচহাত দূরে। চাঁদটা প্রত্যেকে তারা ধরে ফেলার চেষ্টা করেছিল। একেক সময় মনে হচ্ছিল পারা যাবে, এই তো চাঁদ কত কাছে! এই খেলায় চাঁদেরও নিশ্চয়ই সায় ছিল। তা নইলে সারারাত নেচে, গেয়ে, দৌড়োদৌড়ি-হুড়োহুড়ি করে চাঁদ ধরার চেষ্টা কি করত তারা? আর একেবারে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠার আনন্দ তারা পাচ্ছিল চাঁদের হাসি-খুশি প্রশ্রয়েই তো? সেই মাঠ। মনে পড়ে খৈ ফোঁটার মতো চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া নষ্টচন্দ্র রাতের সেই মাঠ।