সুপ্রিয় নতমস্তকে নূতন শিশুটির দিকে চেয়ে রইলো।
অনেকক্ষণ পরে মুখ ফিরিয়ে নন্দিতা বললে, বাড়ির খবর কি? ঠাকুর চাকর আছে তো?
আছে।
ঠিক সময়ে খাওয়া-দাওয়া হয়?
হ্যাঁ। ভাঁড়ারের চাবিটা নিজের কাছে রাখো তো?
হ্যাঁ।
একটু চুপ করে থেকে নন্দিতা বললে, কুকুরটার খোঁজ পেলে কিছু?
নিশ্বাস ফেলে সুপ্রিয় সজাগ হয়ে বললে, হ্যাঁ, দশবারো দিন পরে কাল সকালে দেখি, আমাদের বার বাড়ির সিঁড়ির তলায়।
পোড়ামুখী ছিলো কোথায় এ ক-দিন?
সুপ্রিয় হেসে বললে, আরে সেই কথাই তো বলছি। তোমার ভয়ে গা ঢাকা দিয়েছিলো। চেহারা দেখে সন্দেহ হলো, সিঁড়ির তলায় ঢুকে দেখি বেবির তিনটে বাচ্চা হয়েছে।
অ্যাঁ?
বাচ্চা গো। একটা নয়, তিন তিনটে। আর তাকে তাড়াতে তোমার মন উঠবে না দেখো। কী সুন্দর দেখতে হয়েছে বাচ্চাগুলো!
নন্দিতা মুখ ফিরিয়ে নিঃশব্দে পড়ে রইলো।
হে আনন্দ – রাহাত খান
এগারোটা বেজে তিন মিনিটের সময় রকিবুল হোসেনের সবুজ টেলিফোন ভালো একটা খবর ধরল। অনেকদিন থেকে আদায় হতে চায় না, একেবারে আদায় হতে চায়না, এ ধরনের বড় অঙ্কের একটা টাকা আদায় হওয়ার খবর। ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে অফিসের জুনিয়র এক্সিকিউটিভ কিবরিয়া হয়া গেছে স্যার, বলল। খেলা জিতে যাওয়ার গলায়। পরে বলল, চেক নিয়া আসতেছি।
রকিবুল হোসেনই ধরেছিল। তার চেম্বারে প্রায় রোজ এ সময় মিটিং বা আড্ডা মতোন হয়। ঘরে বন্ধু দিল হাসান ছিল। কদিন থেকে তার বান্ধবী তাকে খুব ভালো। সময় যুগিয়ে যাচ্ছে। ঘরে আর বসেছিল ম্যানেজার হরিপদ সরকার। টেলিফোনটা চুপচাপ ছেড়ে দিয়ে রকিবুল ভাবে খবরটা কি বেশ একটা চীৎকার দিয়ে উঠে হাসি খুশিতে ফেটে পড়ে তার বলা উচিত ছিল না? সে রকমেরই তো দারুণ সুসংবাদ একটা। কেননা এই টাকাটা পাওয়ার কথা ছিল না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বুঝল দেরি হয়ে গেছে। যখনেরটা তখন দিয়ে ফেলা উচিত। এখন চেঁচালে উদ্ভট দেখাবে। খুশিটা যে বানোয়াট তা সবাই বুঝে ফেলবে। ভেতর থেকে আপসে আপ না এলে চেঁচাই কি করে! ওরকম পারে মানুষ?
রকিবুল মনস্থির করতে পারা না পারার মধ্যে ভাবে। পরে ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে সেঁতো হাসির সাথে প্রবল আনন্দ বুঝাবার চেষ্টা করে বলে : হয়ে গেছে। হয়ে গেছে’র বৃত্তান্ত ভেঙে বলল। বলাটা তার তেমন খারাপ হচ্ছিল না। আনন্দ না হোক, উত্তেজনার টুকরা-ফাঁকরা বেশ প্রকাশ পাচ্ছিল।
শুনে আগেভাগে চীৎকারটা দিল হাসান। যদিও তার জিনিসটার মধ্যে আগুনের চেয়ে ধোঁয়া বেশি ছিল। স্বাভাবিক। পড়শি বা বন্ধুদের কেউ লটারি জিতে গেলে, হঠাৎ একদিন বনানী-গুলশানে জমির এলটমেন্ট পেয়ে গেলে বা প্রায় তামাদি হয়ে যাওয়া পি. ডব্লিউ, ডি’র একটা সাড়ে বাষট্টি লাখ টাকার চেক আদায় পেয়ে গেলে এভাবে মানুষের ভেতরে খুব জ্বলুনি-পুড়ুনি হবে না? বেরোবে না গলগল করে কালো ধোঁয়া। চীৎকার ও হাসি কতটাইবা পারে ভেতরের দাগা চাপা দিতে?
দিল হাসান বু চমৎকার পেরেছে বলতে হয়। হাসিটা ভালোই দিল। দাঁত দেখাবার সময় দেখাচ্ছিল আনন্দ বা হাসি-খুশি প্রকাশের মতই বেশ ঝকঝকে। চেঁচিয়ে ওঠাটা ছিল রীতিমতো উঁচুদরের। যাকে বলে উইথ কনফিডেন্স। সে বলছিল আরে, কও কি মিঞা। আরে কও কি মিঞা, দুতিনবার বলল। ক্রমাগত একটা জিনিস ধরে টানলে যা হয়, তার প্রাণবায়ু ফুরিয়ে যাচ্ছিল। তবু সব মিলিয়ে তার দেখানোটা খারাপ ছিল না।
: ভালো একটা পার্টি চাই দোস্ত। মিষ্টিফিষ্টিতে হবে না।
: ঠিক আছে, হবে পার্টি।
: হবে পার্টি? ফাঁকেলাস। পার্টি হবে? দুর্দান্ত! আমি দোস্ত চিবাস রিগ্যালের নীচে নামব না! কথা দে…
ও ননা প্রবলেম! টপ অব দা ক্লাবে পার্টি হবে।
: টপ অব দা ক্লাবে? ফাসকেলাস! দুর্দান্ত…
: নো প্রবলেম! টপ অব দা ক্লাবে পাটি হবে।
: টপ অব দা ক্লাবে? ফাসকেলাস! দুর্দান্ত…
দুই বন্ধুতে এইরকম হচ্ছিল….! রকিবুল হোসেন জেগে উঠতে চাইছিল দিল হাসানের সাহায্য নিয়ে। যদিও আপসে আপ জিনিসটা আসছিল না। তবু হয়তো আমোদ-ফুর্তির কথা বলতে বলতে, চেঁচাতে চেঁচাতে সেই সুন্দর ঝর্ণা বুকের ভেতর এক সময় বেজে উঠবে। কে জানে। চেষ্টা করে দেখা যাক!
ম্যানেজার হরিপদ প্রকার ‘ব্যাংকে একটা ইনফর্মেশন দিয়ে রাখি’ বলে সরে পড়ে। মুখোমুখি দিল হাসান ও রকিবুল হোসেন। পার্টির কথা শেষ হয়ে তখন দিল হাসানের নিজের কথা। দোস্ত, শি ইজ ফেটাস্টিক। কসম, এরকম আর পাইনি। বলছিল ও মনের থেকে কিছু মণিমুক্তো তুলে আনতে পারছিল। ইংরেজি ও বাংলা শব্দ মিলিয়ে দিল হাসানের দেওয়া জুলেখার চুলের বর্ণনা ভারী সুন্দর। জুলেখা মানেও তো কেশবতী। দিল হাসান বলল যে জুলেখা সত্যি সত্যি দিতে জানে। মহিলা ভারী দুঃখী। এতকাল স্বামীর অবজ্ঞা-অবহেলা শুধু পেয়ে আসছিল। আহা বেচারী। ইচ্ছে করলে রকিবুল একদিন গিয়ে দেখে আসতে পারে। সময়কে আনন্দে ভরিয়ে তোলার দারুণ ক্ষমতা রাখে মহিলা।
রকিবুল শুধু জানতে চেয়েছিলে মহিলাকে দিল হাসান বিয়ে করে ফেলবে কি। গাড়ি করে বাসায় ফেরার সময় আরো মনে পড়ে কাকে যেন রকিবুলও একদা বিয়ে করে ফেলতে চেয়েছিল। অমলা না পারভিন, কে সে?
কারো সাথে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল না। দূর থেকে রূপে মুগ্ধ হওয়া যাকে বলে। তার গাড়ি বেশ স্পীডে যাচ্ছিল। সে কতদিন আগের কথা। রকিবুলের মনে পড়ে, মধুখালিতে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া বৃষ্টির কথা। নদীর পাড় ছিল নির্জন। রাচর জুড়ে কুয়াশার মতো জেগে আছে বৃষ্টির রঙ ও ক্যানভাসে সেঁটে থাকা গ্রাম ও গাছপালার সুজ এখানে-ওখানে। নাদেরাই তাকে হাসতে হাসতে অতর্কিতে ধাক্কা দেয়। ব্রহ্মপুত্র নদে বৃষ্টির ঝাঁঝরা হতে থাকার সময় ভেতরের জল ছিল নরম ও উষ্ণ। সেই মধুখালি। সেই বৃষ্টির সময়টা। নাদেরা তারপর নিজেও নদীতে নেমে গৃহহীন হয়েছিল।