সন্ধ্যার সময় সুপ্রিয় ফিরে এলো। সে আসে একটা সমারোহ সঙ্গে নিয়ে। মোটা টাকা মাইনে পায়, কিন্তু রোজ রোজ নতুন নতুন মোটরে চড়বার লোভে সে দামী ব্যাক্সি চড়ে আসে—মোটর আজো কেনেনি। সঙ্গে আসে মনিহারি, ব্যাঙ্কের খাতাপত্র, চৌরঙ্গী গ্রীলের খাবার, নিউমার্কেটের ফুল—কোনো কোনো দিন মুখরোচক অসাময়িক দামী আনাজ-তরকারী।
গাড়ি থেকে নেমে এসেই স্ত্রীর দিকে চেয়ে সে একেবারে বিস্ময়ে স্তম্ভিত। আজ কি ভুল করে সে অন্য বাড়ি ঢুকেছে?
কাছে এসে নন্দিতা বললে, দেখছো কি বোকার মতন? এই বলে মাথার টুপিটা খুলে নিলো।
সুপ্রিয় শুধু বললে, হতবুদ্ধি!
অমন হাঁ করে থাকলে আমি কিন্তু সব টান মেরে খুলে ফেলবো।
আজ তার কপাল থেকে সিঁথির ভিতর অবধি সুদীর্ঘ বিস্তৃত সিন্দুররেখা।
পরনে গঙ্গারঙের রেশমী রাঙাপাড় শাড়ি, আঁচলে চাবির গোছা, মাথায় ঘোমটা। সুপ্রিয় রাঁধুনী বামুন আর চাকরটাকে লুকিয়ে নন্দিতাকে কাছে টেনে নিলো। বললে, নতুন কিনা, তাই ভালো লাগছে।
নন্দিতা বললে, আজ কিন্তু তোমাকে কোথাও যেতে দেবো না।
সে কি, গাড়ি আনলুম যে তোমার জন্যে! তুমিই তো বেড়াতে যাবার জন্য পাগল, আমাকেই তো তুমি তিষ্ঠতে দাও না।
না, চলো ছাদে বেড়াবে, আজ পূর্ণিমা।
গাড়ি ফিরে গেলো। ঠিক বোঝা গেলো না–নতুন করে মিলনের আনন্দ, অথবা আজ অভিনব উপায়ে পরস্পরকে জানার আগ্রহ? রমণীর বেশ ছেড়ে আজ হঠাৎ গৃহলক্ষ্মীর ছদ্মবেশ কেন।
গলা ধরাধরি করে উপরে উঠে গিয়ে সুপ্রিয় বললো, রস ঢেলে দিয়ে আজ মাতাল করবে, না অমৃত ঢেলে ঘুম পাড়াবো নন্দনবাসিনী?
সুপ্রিয়র বোতাম খোলা কোটটা মুখের উপর টেনে নন্দিতা বললে, রসটা হেঁকে নিলেই অমৃত।
সঙ্গীত না সুভাষণ?
দুটো মিলিয়ে যা হয়–কবিতা! ঘরে চলো।
ঘরে ঢুকে সুপ্রিয় অবাক হয়ে গেলো। যে ঘরে সকালবেলা সে ছিলো, এ ঘর সে নয়। তার চকচকে চোখের তারা চারিদিক থেকে ঠিকরে পড়তে লাগলো। যা ছিলো তা সবই আছে, কিন্তু ভিন্ন চেহারায়, ভিন্ন ভঙ্গিতে পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে নয়, প্রাণ-বৈচিত্রটাই যেন সজীব। এ দেয়ালের ছবি ও দেয়ালে, এধারের খাট ওধারে, নতুন হয়ে এসেছে ফুলদানি, চায়না গ্লাস ঘুরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে দক্ষিণে, মখমলের জাজিমে রেশমী তাকিয়া পোট্রেটগুলোর বদলে ল্যান্ডস্কেপ এসে সমস্ত ঘরখানার ভিতরে কল্পনার একটা অসীম ব্যাপ্তি এনে দিয়েছে।
পর্দা সরিয়ে ঘরের ভিতর দিয়ে অন্য ঘরে নন্দিতা স্বামীকে নিয়ে গেলো। এ আবার নতুন জগৎ। এধারে সোফা আর ইজিচেয়ারের সেট, ওধারে পিয়ানো। দেয়ালের গায়ে গায়ে বইয়ের আলমারি, কোণে কোণে পিতল আর পাথরের পুতুল মাঝখানে কাঁচের টেবলের উপর চীনা আর তিব্বতী কিউরিয়ে, জানালার
স্ক্রীনগুলিতে সুন্দর কারুকলা চিত্রিত।
সুপ্রিয় বললে, পেলে কোথায় এত!
নন্দিতা বললে, সবই ছিলো।
দেখতে পাইনি তো?
চোখ ছিলো না তোমার। এসো, এবার কাপড় ছাড়বে।
শোবার ঘরে এনে সুপ্রিয়কে খাটের উপর বসিয়ে নন্দিতা তার পায়ের জুতো আর মোজা খুলে নিলে। ঠাকুর খাবার নিয়ে এলো হাতে করে। কচুরি, নিমকি আর সন্দেশ দেখে সুপ্রিয় বললে, কি রকম যেন একটা ষড়যন্ত্রের আভাস পাচ্ছি। হঠাৎ আজকে এমন রাজোচিত আতিথেয়তা আরম্ভ হলো কেন ব্যাপার কি বলো তো ঠাকুর?
ঠাকুর টিপাইয়ের উপর খাবার আর জল রেখে যাবার সময় বলল, সবই মা তৈরি করেছেন।
লক্ষণ ভালো নয়। যুদ্ধের চেয়ে সন্ধির চেহারা দেখলেই আমার ভয় করে।
কেন?–নন্দিতা হাসি মুখে প্রশ্ন করলে।
মনে হয় তখন বুঝি তোমাকে আর চিনতে পাচ্ছিনে।
ঝগড়া করে কী হবে?
সুপ্রিয় বললে, এতেও আমার দুশ্চিন্তা। তুমি চুপ করে থাকলেই মনে হবে দূরে সরে যাচ্ছে। তোমার মুখ বন্ধ হলেই আমার হবে পরাজয়। আমি সীতাও চাইনে, দ্রৌপদীও নয়, আমি চাই সুভদ্রাকে। আমার হাতে ধনুর্বাণ, তার হাতে অশ্ববহ্মা!
হয়েছে। ‘এবার বীরের তুনুতে লহ তনু।’ এই বলে উঠে নন্দিতা হাত ধুয়ে স্বামীর মুখে একখানা কচুরি পুরে দিলো, তারপর সুপ্রিয়ের কোমরের বোতামগুলি খুলে ট্রাউজার ছাড়িয়ে নিয়ে ধুতিখানা জড়িয়ে দিতে লাগলো।
মাস পাঁচেক পরে অত্যন্ত উদ্বেগ নিয়ে সুপ্রিয় সেদিন সন্ধ্যার সময় হাসপাতালে খবর নিতে এলো। ডাক্তার হাসিমুখে বললেন, কেবিনে যান, আপনার স্ত্রী ভালো আছেন।
মুখের উপরকার অস্বস্তির ছায়া আনন্দে রূপান্তরিত হলো। সুপ্রিয় সোজা দোতলায় উঠে গিয়ে সাত নম্বর কেবিনে ঢুকলো। নার্স নমস্কার জানিয়ে বললে সন্দেশ আনুন।
সুপ্রিয় হাসলো, তারপর আড়ষ্ট পা দুখানা টেনে নন্দিতার কাছে এসে দাঁড়ালো। আজ আবার স্ত্রীর সঙ্গে তার নতুন করে পরিচয়। লজ্জা নয়, কিন্তু আনন্দের অসহনীয় অস্বস্তিতে নন্দিতা বালিসে মুখ লুকিয়ে রইলো; মিনিট দুই পরে দেখা গেলো, তার নাক বেয়ে অশ্রুর ধারা গড়িয়ে পাশের নবজাত সুন্দর শিশুর ছোটো বালিশটিও ভিজে গেছে।
নার্স বাইরে গেলো। মাথার কাছে বসে রুমাল দিয়ে সুপ্রিয় নন্দিতার চোখ মুছিয়ে দিলো। হাতখানা একটু কাঁপলো। রমণী রূপান্তরিত জননীতে—আজ তাকে মোগ্য সম্রম না দিলে আর চলবে না। সুপ্রিয়ের হাতখানা আবার সন্তর্পণে ফিরে এলো। কিন্তু অশ্রু কেন আজ? হয়তো নন্দিতার সেই জীবনটা এবার মুছে গেলো—সেই দেওদারের ছায়াপথ, প্রিয় সান্নিধ্যে সেই অপরূপ জ্যোৎস্নার অবগাহন, চৌরঙ্গীর আবেশ-বিহ্বল স্বপ্নলোক, তরুণ কৌমার্যের মালঞ্চে বাসকশয্যা। সেই জীবনের বিচ্ছেদ-বেদনা আর এই নূতন জীবনের আনন্দ—হয়তো এই অশ্রুতে তার বিচিত্র সংমিশ্রণও ছিলো।