না।–বলে নন্দিতা কাছে এলো। সুপ্রিয়র গলাটা তার চুড়িরা দুই হাতে জড়িয়ে ধরে কাঁধের ওপর মুখ রেখে বললে, তোমার আর কোনো নেশা আমার। বরদাস্ত হয় না।
সুপ্রিয় বললে, কেন বলো তো? শুনলে তুমি আস্পর্ধা পাবে তাই বলতে ইচ্ছা করে না। আচ্ছা বলল, অভয় দিচ্ছি।
নন্দিতা বললে, সহজে তো পাইনি, পেয়েছি অনেক দুঃখে, তাই কেবলি যারবার ভয়। তুমি আর কিছুতে মন দিতে পাবে না।
সে কি ঈশ্বরচিন্তাও নয়?—সুপ্রিয়র চাহনিতে ভীষণ বিস্ময়।
নন্দিতা তার মুখখানা টিপে ধরে বললে, নাস্তিকের মুখে ঈশ্বরের নাম শোনাও পাপ। আর বলবে?..বলবে আর?
আঃ ছাড়ো, সতী নারীর চুড়ির ঘায়ে মুখখানা কেটে গেলো বুঝি।
বেবি এইবার কোনো আসন্ন দুর্যোগের আশঙ্কা করে পাশ কাটিয়ে ঘর থেকে উঠে বেরিয়ে গেলো। সুপ্রিয় বললে, ওর সঙ্গে তোমার একটা আড়ি আছে।
হেসে নন্দিতা বললে, ও আমার চোখের বালি। ঐ যে বেরিয়ে গেলো, এ বেলায় আর বাড়ি ঢুকবে না।
সুপ্রিয় তার কোমরে বাঁ হাতখানা জড়িয়ে বললে, সংসারের সঙ্গে তুমি মানাতে পারো না, তাই আমার সঙ্গে ঝগড়া বাধাও তাই না?
অমনি গোঁজামিল দিচ্ছ, কেমন?–নন্দিতা বললে, ঠিক উল্টো, তোমাকে বাগ মানাতে পারিনে ঘরকন্নায়, তাই এতো ঠোকাঠুকি। এই যে সকালবেলা থেকে বসে রইলে, করলে কি বলল দেখি?
করতে তো বলোনি?
বলে না দিলে বুঝতে পারো না? বাজার হলো কোত্থেকে, রান্না হলো কি দিয়ে? না হয় জানলুম চাকর-বামুন আছে কিন্তু খোঁজ-খবর রাখা?
সুপ্রিয় বললে, এও আমাকে করতে হবে? বিয়েটা ফিরিয়ে নাও নন্দিতা, এসব আমি পারবো না। বলো কি, বাজারের হিসেব? মুদির ফর্দ? গয়লার পাওনা?
একখানা চেয়ারেই দুজনে ঠেসাঠেসি করে বসল, নন্দিতা হেসে বললে, ধোপর খাতা, বাড়িভাড়া, ঘুঁটে কয়লা —তাছাড়া ডাক্তারি, মনিহারি, স্যাকরা, আরো কতো কি।
আমাকে মুক্তি দাও, নন্দিতা। এসব আমি পারবো না।
নন্দিতা স্বামীর গায়ে মুখখানা বুলিয়ে বললে, আরো রইলো। ব্যাঙ্কের জমাখরচ, পোস্টাপিসের খাতা, ইনসিওরেন্সের পলিসি, পাটকলের শেয়ার, তোমার বাড়ির খাজনা, ইনকাম ট্যাক্স, সব ছাড়িয়ে তোমার চাকরি।
ব্যাকুল হয়ে সুপ্রিয় বললে, সবই ঠিক কিন্তু আমি কী অপরাধ করেছি? বিয়ে ফিরিয়ে নাও, নন্দিতা। বিয়ে আমি করিনি, ঘরকন্না আমি মানিনা আমাকে ছেড়ে দাও, কেঁদে বাঁচি।
নন্দিতা তার চিবুক নেড়ে দিয়ে বললে, তখন মনে ছিলো না?
কখন গো?
দেবদারুর ছায়ার নীচে দাঁড়িয়ে কি প্রতিজ্ঞা করেছিলে?
সুপ্রিয় বললে, তখন কে জানাতে তোমাকে পাওয়া মানে এতোখানি উৎপীড়ন মাথা পেতে নেওয়া? হ্যাঁ, প্রতিজ্ঞা আমি করেছিলুম, মহারানীর সকল দায়িত্ব আমি বহন করবো।
তবে?–নন্দিতা প্রশ্ন করল।
দাঁড়াও, তখন গয়লা-মুদি-ধোপা কয়লাওয়ালা কেউ গিয়ে দাঁড়ায়নি। তোমার প্রেমে মজতে গিয়ে তোমার ঐ বর্বর সন্তানদলের বীভৎস আক্রমণ আমাকে সইতে হবে এমন কথা হয়নি?
নন্দিতা বললে, তবে না হয় চলো পালিয়ে যাই কোথাও?
যেখানেই পালাবো তোমাকে নিয়ে, সঙ্গে থাকবে এই গোলকধাঁধা আর এই প্যারাফারনালিয়া! আর যাবেই বা কোথায় তুমি তোমার এই শরীরে?
স্বামীর কাঁধের ওপর মাথা রেখে নন্দিতা বললে, সব গুলিয়ে দিলে তুমি। কিসে কি হলো আমিও ঠিক বুঝতে পারলুম না।
সুপ্রিয় বললে, পারবে আর কিছুদিন পরে। আমি কিন্তু বলে রাখছি নন্দিতা, হয় বিয়ে ফিরিয়ে নাও আর নয়তো তোমার সন্তানদলের ছোঁয়া থেকে আমাকে বাঁচিয়ে রেখো। বিয়ে মানে দায়ত্বি, কিন্তু দায়ত্বি মানে ভদ্রজীবনের উপর অত্যাচার নয়। টাকাকড়ি ঘরকান্না সবই তোমার আর তুমি কেবল আমার,–এই শর্ত।
নন্দিতা তার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে বললে, তুমি কি সিরিয়াস?
হাফ সিরিয়াস। কারণ মনের কথা হেসে না বললে তোমার দরবারে আবেদনটা পৌঁছবে না।
উঠে দাঁড়িয়ে নন্দিতা বললে, কোনো শর্তে আমি সংসার করতে পারবো না। তোমার যা খুশি তাই করো।
সুপ্রিয় বললে, এই অত্যাচার সইতে গিয়ে যদি আমার মত্যু ঘটে?
ঝংকার দিয়ে নন্দিতা বললে, তবে তোমার চামড়া নিয়ে ডুগডুগি বাজাবো। এই বলে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
বেলা এগারোটার পর সুপ্রিয় খেয়ে দেয়ে আপিস বেরোলো। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেলো প্রবল উৎসাহে নন্দিতা ঘরের কাজে মন দিয়েছে। চাকরটাকে বললে, উপরে আয় একবার আমার সঙ্গে এই বলে সে কোমর বেঁধে একটা প্রবল তাড়নায় কাজে লেগে গেলো। নতুন করে ভাবতে সেও জানে। মেয়েদের সৃষ্টিশক্তি নেই, এমন মবাদ যাদের, নন্দিতা তাদের প্রদি। নন্দিতার অত্যধিক পরিশ্রম, অতিরিক্ত ছুটোছুটি আর হাঁটাহাঁটি ডাক্তারের নিষেধ। কিন্তু আজ তাকে বাগ মানানো যাবে না। স্বামীর মনের প্রবাহটা আবিল হলে স্ত্রীর পক্ষে দুর্দিন কিনা নন্দিতার জানবার দরকার নেই। কিন্তু পুরুষকে ঠিক বুঝতে না পারলেই নারীর মনে জমে ওঠে আশঙ্কা, তখন চুম্বন—আলিঙ্গনের আতিশয্যটাও নির্ভুল নিরাপদ বলে মনে হয় না। পুরুষের প্রাণের চিন্তাধারার সম্বন্ধে নিঃসংশয় হতে না পারলে মেয়েদের স্বস্তি নেই।।
ঘণ্টাখানেক পরে দেখা গেলো অতিশয় পরিশ্রমে নন্দিতার কপালের চুলের আঙটগুলি বেয়ে কোমল কয়েকটি ঘামের ধারা নেমে এসেছে গাল বেয়ে। মুখে ললিত রক্তাভা, যেন ভিতর থেকে প্রভাতের তরুণ সূর্যোদয়ের আভাস। কিন্তু আর একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সবগুলিই ঘামের ফোঁটা নয়, টলটলে অশ্রুর ধারাও নেমে এসেছে তার সঙ্গে। বিড়ম্বিত জীবন তার নয়, কিন্তু এতদিন পরে আজ যেন একটা আকস্মিক ঝাপটায় মনে হচ্ছে, সর্বস্বান্ত হয়েও একজনকে আজও পরিপূর্ণ পাওয়া যায়নি, জটিল রহস্যের আঁকাবাঁকা পথে এখনও রইলো সে অনেক দূরে, হয়তো ঘোমটা সরিয়ে ধীরে ধীরে তাকে আবিষ্কার করলেই পাওয়া সহজ হতো। সংশয়ের দ্বন্দ্বে আর বুঝতে না পারার অনুতাপে নিরুপায় নন্দিতার মনে কেমন যেন একটা আসন্ন ভূমিকম্পের থরো থরো কম্পন এপার থেকে ওপার পর্যন্ত শঙ্কায় আকুল করে তুলেছে। ওদের ভালোবাসার আগডালে সুগন্ধ ফুল ধরেছে সন্দেহ নেই, কিন্তু মৃত্তিকার নীচে মূল এখনও গভীরে নামেনি। ফুল ফোঁটার চেয়ে শিকড়ের দিকে কোনো নজর নেই।