বোতামটা অবশ্য ধোপার বাড়ি থেকেই ছিঁড়ে এসেছে।
কিন্তু নন্দিতা বলে, আমিই ছিঁড়েছি, বেশ করেছি।
এর ক্ষতিপূরণ?
ওঃ গবর্ণর এলেন শাসন করতে! যাও, বেরোও।
বাঁকা চোখে চেয়ে সুপ্রিয় বলে, মনে রেখো আমি যদি পায়ে রাখি তবেই তুমি দাসী।
ঝংকার দিয়ে নন্দিতা বলে, ওরে চরিত্রহীন, দাসীর সঙ্গে কোনো ভদ্রলোক—হঠাৎ সুপ্রিয় দার্শনিক হয়ে ওঠে,—তাই তো ভাবছি, ঠিকই বলেছো। আমি ভাবি চতুরা স্ত্রীলোকের কী অদ্ভুত ইন্দ্রজাল!
আমি চতুরা—?–নন্দিতা বলে, ভিক্ষে চাইতো কে পেছনে পেছনে এসে? সাবধান কিন্তু সুপ্রিয়, আমি হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেবো বলছি।
মুখের হাসি টিপে সুপ্রিয় বলে, আচ্ছা, দাও ভেঙে, দেখি তোমার হাঁড়িতে আর কি কি ‘সন্দেশ’ আছে। আমিও তখন বলবে, হে সমবেত ভদ্রমহোদয়ও ভদ্রমহিলাগণ, আপনারা সকলে শ্রবণ করুশ, একটি বিষধর উর্ণনাভের জালে একটি নিরুপায় মক্ষিকা আবদ্ধ হয়েছিলো। একটি অদ্ভুত চক্রান্তে সে বন্দী!
মুখখানা বিকৃত করে নন্দিতা বলে, মক্ষিকাই বটে, আঁস্তাকুড়ের মাছি।
থুড়ি।–সুপ্রিয় বলে, মক্ষিকা নয়, ভ্রমর। আর সেই ভ্রমরের পাখার গুঞ্জনে কস্তুরাগ শুনে রক্তগোলাপ মাথা দুলিয়ে উঠতো।
অমনি নন্দিতা হেসে ফেলে, আমি মাথা দোলাতুম? কী মিথ্যেবাদী তুমি? কবিতা লিখে পাঠাত কে শুনি?
পুরনো কথাটা সুপ্রিয় স্মরণ করিয়ে দেয়, কবিতার সুখ্যাতি করতে কে শুনি?
নন্দিতা বলে, স্বপ্নকন্যার রূপের প্রশংসা করোনি তুমি? আমরণ উবাসের ভয় দেখিয়েছিলো কে?
উত্তরটা তখনই সুপ্রিয় জুগিয়ে দেয়, হে ঈশ্বর, তুমি সাক্ষী। করি কোঁকড়া চুল আর কালো চোখের তারার কে জানিয়েছিলো সুখ্যাতি গোপনে?
নিজের চেহারার কী গর্ব! বেহায়া!
–বলে তখন নন্দিতা রণে ভঙ্গ দেয়।
আগে নতুন ঘরকন্নায় সুপ্রিয়র মন বসতে চায়নি। আগে মনে হয়নি তাকে ভাবতে হবে বাজার খরচের কথা, তেল-নুনের খবর, চাকরবামুনের মাইনে। এ যেন তার কাছে একটা অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক সমস্যা। নন্দিতাকে সে বরাবর জানিয়ে এসেছে। আকাশের চেহারাটা উজ্জ্বল নীল আর লোয়ার সার্কুলার রোডের রাত্রির দৃশ্যটা হেমরে কুয়াশা আর স্তিমিত আলোকস্তম্ভ মিলিয়ে একটা স্বপ্নজড়ানো রহস্য পথ। নন্দিতার চুলের অরণ্যে বর্ষার যেন ঘনঘটা, আর মুখে শরতের সোনার রৌদ্র ঝলোমলো, আর আঁচলে উচ্ছ্বসিত চৈত্ৰ পূর্ণিমার দোলা। আগে সুপ্রিয় ঘুমিয়ে পড়তে নিবিড় তন্দ্রায় মোটরের মধ্যে নন্দিতাকে ঘিরে, রবারের চাকায় জড়িয়ে যেত কলকাতা শহর পাকে পাকে, ঘন আলিঙ্গনে যেতো মিলিয়ে রেড রোড আর চৌরঙ্গীর। পাতালপথ। আশ্চর্য সেই অতিপরিচিত অপরিচয় কথা বললে যেন ধ্যান ভেঙে যেভো। ঘুমের রসে টস টস করছে কণ্ঠস্বর—যেন দূরের কোন্ এক তপোবনে তপস্বীর মৃদু স্তবগান।
দেওদারের স্তব্ধ বিশাল ছায়ায় দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চক্ষে সুপ্রিয় বললে, ঘোমটা দাও মাথায়।
না।–নন্দিতা আদরে জড়িয়ে বললে, আড়াল করতে পারবো না তোমাকে।
আড়াল খুলে আবিষ্কার করে নেবো।
লজ্জা করে যে তোমার সামনে ঘোমটা দিতে।
কেন?আগে থেকেই তো দেখে নিয়েছে। আড়ালে রাখার আর আছে কি?
শীতের মধ্যাহ্নে দেওদারের নিভৃত স্তব্ধ ছায়ায় দাঁড়িয়ে নন্দিতা আবার বললে, নস বউ আসে ঘোমটা দিয়ে, সেইজন্য তাকে খুঁজে বার করতে হয়।
সুপ্রিয় বললে, হলো না। রকে যতোই জানতে থাকে ততোই ঘোমটা খোলে মেয়েরা।
বিয়ের পরেও নন্দিতা ঘোমটা দিলো না, সিঁথির সিন্দুর লুকিয়ে রাখলো একপাশে চুলের ঘন অন্ধকারে—অরণ্যের গভীরে যেমন গোপনে থাকে অগ্নিশিখা। এটা কেমন তরো? নন্দিতা বললে, আমাদের তরুণ কৌমার্যকে জাগিয়ে রাখবো দুজনের সামনে কিন্ত্ত করে।
রাখিপূর্ণিমার রাত্রে ওরা স্টীমারে চলেছিলো বদরতলা পেরিয়ে। আকাশের এক পারে শরতের চন্দ্র, অন্যপারে মেঘের মন্দ্র। সুপ্রিয় বললে, পারবে?
তার হাতখানা হারে মধ্যে নিয়ে নন্দিতা নতমুখে বললে, বোধ হয় পারবো না। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো প্রতিজ্ঞাই থাকে না।
সুপ্রিয়র কণ্ঠস্বর সেই চন্দ্ৰব্বণ নদীর উল্লোলে উচ্ছ্বসিত দোলায় দুলে উঠলো। অনাদি আর অনন্তকাল তার সেই আবেগের মুহূর্তের উপরে দাঁড়িয়ে থর থর করে কাঁপতে লাগলো। বললে, নন্দিতা, ভুলতে ইচ্ছা করে না আমাদের সেই প্রথম পরিচয়ের উল্লারে দোলা, আমার বুকের রক্তে যখন কবিতা লিখেছিলুম আর তুমি সেই রক্তে দুই চরণ রাঙিয়ে এসে দাঁড়ালে।
স্টীমার সেদিন যেন জীবন-মরণ বিদীর্ণ করে চলেছিলো পৃথিবী ছাড়িয়ে অথৈ অজানায়।
সুপ্রিয়র চমক ভাঙলো। এর মধ্যে কখন বেবি নীচে থেকে এসে তার পায়ের তলায় আশ্রয় নিয়েছে। সেদিনটা নেই বটে, কিন্তু এখন এসেছে একটা প্রকাণ্ড ব্যাপ্তি। প্রথম প্রবাহটার সেই খরবেগ এখন মন্থর, জীবনযাত্রাটা দুই দিকে এখন বিস্তৃত, গভীর হয়েছে বলেই উপরটা প্রশান্ত, প্রথম অবস্থাটা চঞ্চল ছিলো বলেই দিশাহারা, এখন লক্ষ্যটা স্থির, তাই নিরুদ্বেগ।
চুড়ির আওয়াজে সুপ্রিয় মুখ ফিরিয়ে তাকালে। নন্দিতা ঘরে এসে দাঁড়িয়ে বললে, পায়ের তলায় এসে বুঝি ঢুকেছে? ওকে আমি তাড়াবো।
সুপ্রিয় বললে, তাড়ালে যাবে কোথায় বেচারা!
কুকুরের নেশা নিয়ে তোমাকে আমি থাকতে দেবো না।
তুমি ছাড়া আমার বুঝি আর কোনো নেশা থাকতে নেই?