তালে বল সমীরণ আমায় করে দেবে তো!
দেব রে বাবা দেবো, ঠিক করে দেবো। তোমায় না করে দিলে কাকে করে দেবো বল!
এই না হলে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, বল সমীরণ!
হরপার্বতী সংবাদ – প্রবোধকুমার সান্যাল
মাথার চুলের রাশির মধ্যে দাঁড়া চিরুনিখানা টানতে টানতে নন্দিতা বললে, বলেছিলাম না তখন? এখন শুনতে পাচ্ছ তো?
টেবিলের কাগজপত্রের উপর কলমটা রেখে মুখ ফিরিয়ে সুপ্রিয় বললে, শুনিনি কিছু, অতো গোলমাল কিসের?
জানো না? আদর দেবার বেলায় তখন তো দশখানা হাত বের করবে। আমি তখনই জানি কপালে দুঃখ আছে! এখন সামলাও!
আরে কি হলো তাই আগে শুনি?
হবে আমার শ্রাদ্ধ। ইচ্ছে হয় বাইরে বড়ো বড়ো কান দুখানা পেতে শোনো গে।
সুপ্রিয় হেসে বললে, বড়ো কান আমার না তোমার?
রাগ করে নন্দিতা বললে, আচ্ছা আমার না হয় বড়ো কান আমি গাধা। আর তুমি? দাঁত বার করে হাসছো যে বড়ো? দাঁত নয় দাঁতাল।
সকাল বেলাতেই ঝগড়া আরম্ভ করলে তো? তবু শুনতে পেলুম না বাইরে গোলমালটা কিসের। সুপ্রিয় বললে, আরে শোনো, চলে যেয়ো না–আচ্ছা গাধার কান নয়, ইঁদুরের কান, হয়েছে তো? এবার শোনো।
এলো খোঁপা পিছন দিকে ফিরিয়ে নন্দিতা দরাজর কাছে এসে দাঁড়ালো। এরদৃষ্টিতে চেয়ে বলে, রাতের জানোয়ার দিনে হয় মানুষ, কেমন?
হাসিমুখে সুপ্রিয় বললে, আর একটু কাছে এসো। ঝগড়াও করবে অথবা হাতের নাগালের বাইরেও থাকবে এ আমার অসহ্য। এসো বলছি হাতের কাছে।
মুখ দেখলে ঘেন্না করে।–বলে মাথায় একটা প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে নন্দিতা চলে গেলো।
কিন্তু পড়াশুনোয় সুপ্রিয়র আর মনোযোগ দেওয়া হলো না। বাইরের গোলমাল তখনও থামেনি। উঠে সে বাইরে এসে দাঁড়ালো। ব্যাপারটা অবশ্য এমন কিছুই নয়। তার বেবি কুকুরটা এমন একটা গণ্ডগোল প্রায়ই বাধিয়ে বসে। কুকুরটা আজকাল ভারী দুষ্টু হয়েছে।
শৈশব থেকে এখানে সে মানুষ, আদরে ও যত্নে লালিত, এখন তার চেহারায় ভঙ্গিতে ও কণ্ঠে এসেছে তারুণ্য, রোখটা বেড়ে গেছে। এই পাড়ায় সে কাকে যেন তেড়ে গিয়েছিলো, সে বাড়ির কর্তা গিয়েছেন ক্ষেপে। বলছেন; পুলিশে খবর দিয়ে এখুনি ফাইন করাতে পারি, তা জানো? ওদের জানিয়ে দিয়ো, বড়োমানুষি ফলাতে হয় ভবানীপুর ছেড়ে বালিগঞ্জে যাক্, এদিকে ওসব চলবে না। আমরা হালদার পাড়ার হেলে, অমন ঢের চালাকি দেখেছি।
সুপ্রিয় বললে, তথাস্তু।
মুখ ফিরিয়ে নন্দিতা বললে, নির্লজ্জ তুমি।
কেন নির্লজ্জ? যেতে বলছে বালিগঞ্জে, তাই যাবো।
সুপ্রিয় বললে, হালদার পাড়ায় যে কুকুর মার খায়, বালিগঞ্জে গিয়ে সে মাথায় চড়ে বসে। জানোয়ারের উপর মমতা আধুনিক কালচারের লক্ষণ। তুমিই তো সেদিন বলেছিলে, জানোয়ার থেকেই মানুষ না মানুষ থেকেই জানোয়ার?
ওরে, এই কষ্ট?
আজ্ঞে বাবু?
ওপরে আয়।
চাকরটা উপরে উঠে এলো। নন্দিতা মুখ ঝামটা দিয়ে বললে, হতভাগা তোকে না বলেছি দিনের বেলা বেবিকে বেঁধে রাখবি?
ভীষণ অভিযোগ জানিয়ে কেষ্ট বললে, তাই তো রেখেছিলুম মা, কিন্তু শেকল ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে।
সুপ্রিয় বললে, ওদের বাড়ির লোককে কামড়াতে গিয়েছিলো, না রে?
আজ্ঞে না বাবু, ও লোকটা আকাট মিথ্যক। আমাদের বেবির সঙ্গে অন্য কুকুরের ঝগড়া বেধেছিল, ওনার ছেলে মারলে ঢিল, তাই কেবল একটু গোঁ গোঁ করেছিলো!
নন্দিতা বললে, অন্য কুকুরের সঙ্গে যদি ঝগড়া করে, তুই দরজা বন্ধ করে রাখিসনে কেন?
রাখি বৈ কি মা—কেষ্ট বললে, বুও সেদিন ছুটে বেরিয়ে গেলো অত বড়ো পাঁচিল ডিঙিয়ে। কী গায়ে জোর! মাদী কুকুররা বাঁধা থাকতে চায় না।
থাম, নিজের কাজে যা বলে নন্দিতা তার আগেই নীচে নেমে গেলো। সুপ্রিয় ততোক্ষণে গা ঢাকা দিয়েছে।
একটু পরেই বেবির দীর্ঘ আর্তনাদে আবার সুপ্রিয়র শান্তি ভঙ্গ হলো। পড়াশুনো রেখে নীচে নেমে গিয়ে দেখলো, চেরীগাছের ছড়িটা হাতে নিয়ে কোমর বেঁধে নন্দিতা বেবিকে বেদম প্রহার করতে আরম্ভ করেছে।
সুপ্রিয় দৌড়ে গিয়ে স্ত্রীর হাতখানা ধরে ফেললে।—আরে কি হচ্ছে? অততা মারলে মরে যাবে যে?
মরুক, ওকে আমি খুন করবো।
ও কি, ও যে অবলা!
ছাড়ো বলছি—
না।
তুমি ওকে অতো আস্কারা দাও কেন?
অবলা যে!
ফিক্ করে নন্দিতা হেসে ফেললে। কুকুরটা এই সুযোগে ল্যাজটা গুটিয়ে কাঠের বাক্সর পাশে গিয়ে লুকিয়ে কোঁ কোঁ করে কাঁদতে লাগলো।
হাসিমুখে নন্দিতা বললে, ছড়িগাছা এখনও হাতে আছে সাবধান বলছি।
মুখ টিপে সুপ্রিয় বললে, সাবধানেই তো আছি। আমি মার খেয়ে মরে গেলে কানে হীরের দুল পরতে পারবে তো?
ছড়িগাছা ফেলে দিয়ে নন্দিতা বললে, তাই বলে তোমার কুকুর পাড়ার লোককে কামড়ে আসবে?
আর যারা ঘরের লোককে কামড়ায়?
মুখ ফিরিয়ে বিদ্বেগে নন্দিতা ছড়িগাছা হাতে তুলে নেবার চেষ্টা করতেই সুপ্রিয় সেখান থেকে ছুটে পালিয়ে গেলো।
নন্দিতা ওখান থেকে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, আমি কামড়াই কেমন? হীরের দুলের ধাপ্পা তুমি আর কত কাল চালাবে শুনি?—এই বলে সে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলো।
সুপ্রিয় হাসছিলো। দুজনের ভিতরকার এই অদ্ভুত আর অহেতুক সংঘাতটা প্রায় নিত্য দিনের। এখানে সম্প্রীতির অভাব বলে ভুল ঘটতে পারে, কিন্তু অন্তত ওদের দুজনের মধ্যে সে ভুল ঘটেনি। সুপ্রিয় কাগজপত্রের মধ্যে মুখ রেখে চোখের তারা দুটো উজ্জ্বল করে হাসছিলো। কুকুর কেন, সামান্য ব্যবহারিক খুটিনাটি নিয়েও ওদের দ্বািদ চলে। এই যেমন ধরো সেদিন সুপ্রিয় নিজেই আরম্ভ করলে, শীঘ্র বলো, কেন ছিঁড়ে গেছে জামার বোতাম?