–দুজনে দুজনকে না চিনলে চেনা হয় না। আপনি হাত রান, আমি নেমে যাব। আমাকে অপমান করতে চাইছেন আপনি।
আমার হাসিও পাচ্ছিল, আবার বুকের মধ্যে একটু কান্না কান্না ভাব। এই এক রনের অভিমান। ধৈৰ্য্য শেষ হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটিকে আমি নেমে যেতে দিলাম। নেমে গিয়ে মেয়েটি ব্যাগ খুলে একটা টাকা বার করে আমার দিকে এগিয়ে দেয়। কথা বলতে গেলেই কথা বাড়বে। মেয়েটি তিক্ত গলায় বললো, এই নিন, এই রাঙটুকুর ভাড়া। আমি হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিয়ে ড্রাইভারকে বললাম, চলিয়ে। মেয়েটি এবার একটু হাসলো, বললো আপনার কপালে কেটে গেছে বোধহয়। রক্ত পড়ছে। মুছে ফেলুন।
.
৪.
দূর থেকে দেখেছি, এ বাড়িতে কোনো-দিন ঢুকিনি। দরজা ধাক্কা দিতে প্রতদা নিজেই খুললেন। আমাকে দেখে মুখে চোখে হাসি, বললেন, আরে সন্তু, কি ব্যাপার, এসো, এসো, ভাবতেই পারিনি— কতদিন পর তোমার সঙ্গে দেখা। ইস, একেবারে ভিজে গেছ যে–তোয়ালে দিচ্ছি, মুখটুখ মুছে নাও!
সাদা তোয়ালের মাঝে মাঝে লাল ছাপ পড়তে লাগলো। ইস, কি রিক্তিকর! সুব্রতদা কোনো ভনিতা করলেন না, পুলকের ছোঁয়া লাগা মুখেই বললেন, গায়ত্রীর সঙ্গেই দেখা করতে এসেছো তো? কিন্তু সে কি আর তোমার সঙ্গে আজ দেখা করবে? যা রাগ করে বসে আছে সারাদিন।
—কেন, রাগ করেছে কেন?
কি জানি। সন্ধেবেলা বেরুবে বলেছিল, আমি এত বললুম, কিছুতেই আর বেরুলো না। সকালবেলা খুব একচোট ঝগড়া হয়ে গেছে তো।
—কি নিয়ে ঝগড়া?
সুব্রতদা সস্নেহে আমার কাঁধে দু’হাত রাখলেন। বললেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কি নিয়ে ঝগড়া হয়, তা কি জিজ্ঞেস করতে আছে ভাই?
–সুব্রতদা, আপনি ওকে আবার মেরেছে?
ছিঃ, ওসব কথা জিজ্ঞেস করে না!
কাঁধ থেকে দ্রুতদার হাত সরিয়ে আমি একটু দূরে দাঁড়ালাম। চোয়াল কঠিন। বললাম, সুব্রতাদা, আপনি জঘন্যভাবে অসভ্যের মত গায়ত্রীর ওপর অত্যাচার করেন, আমি সব জানি। এর একটা শেষ হওয়া দরকার।
–সব শেষ হয়ে গেছে। আর কিছু হবে না।
—তার মানে?
—গায়ত্রী আর কখনো তোমার সঙ্গে দেখা করবে না, আমাকে কথা দিয়েছে।
–আমার সঙ্গে দেখা করাটা কোনো ব্যাপার নয়। বিয়ের পর দেড় বছর আরা একদিনও দেখা করিনি। কিন্তু আপনি পশুর মতন… সুব্রতদা, আপনি গায়ত্রীকে জোর করে বিয়ে করেছিলেন কেন?
—নিজে কষ্ট পাবার জন্য। এই ছ’বছর আমার জীবনটা তো জ্বলে পুড়ে গেল।
—গায়ত্রী আপনার সঙ্গে গোড়ার দিকে অনেক মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছে। গায়ত্রীর মত ভালো মেয়ে—
সুব্রতদা পরম আহলাদ পেয়ে হাসার মন মুখ করে বললেন, কিন্তু তার যে একটা উকিল ছিল তোমার মতন—
—আমি কি করেছি?
—তুমি আর কি করবে? তুমি কিছুই করোনি, তোমার কিছু করার সাধ্যও নেই, তুমি শুধু শখের প্রেমিক সেজে থেকেছে। গায়ত্রীর মাথাটা তাতেই বিগড়েছে।
–সুব্রতদা, আমি গায়ত্রীর সঙ্গে একবার দেখা করতে যাবো ওপরে।
—খুব ভালো কথা। তার আগে একটা কথা শুনবে ভাই? মাথা ঠাণ্ডা করে শোনো। গায়ত্রীর সঙ্গে আমার মিটমাট হয়ে গেছে। সে আর আমার অবাধ্য হবে না। তুমি আর মাঝখান থেকে উৎপাত করতে এসো না। ডাক্তার এসে বলে গেছেন, গায়ত্রীর বাচ্চা হবে। চারমাস চলছে।
আমি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়াই। এইজন্যই সুব্রতদার সারা শরীর ভরা খুশী। পুনশ্চ আমার কাঁধে বন্ধুর মত সুব্রতদার হাত। ফিস ফিস করে বললেন, বিয়ে তো কয়রানি এধ্ব বুঝবে না। আমি ব্রারই গায়ত্রীকে বলেছিলাম, আমার দিক থেকে কোন দোষ নেই, ডাক্তার বলেছেন—
—আপনি সত্যি বলছেন?
এ প্রশ্নটা বলার জন্যই বলা! তদার চোখ ঝিকঝিকে, লম্পট পাষণ্ডটা আমার দিকে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মত তাকিয়ে বললো, এসব কথা কেউ মিথ্যে বলে? একটা সিগারেট দাও তো। আছে?
—দোতলা বাড়িটার কোথাও কোনো শব্দ নেই। চাকর-টাকরও কারুকে দেখা যাচ্ছে না। সুব্রতদার কানের কাছে একটুখানি সাবানের ফেনা। এইমাত্র দাড়ি কামিয়েছেন।
—নেই, সিগারেট নেই।
–যাকগে তুমি তাহলে ওপরে যাবে গায়ত্রীর কাছে? ভেবে দ্যাখো, সে এখন মা হতে যাচ্ছে এখন কি আর তোমাদের ও ছেলেমানুষী মানায়?
—শুধু একবার দেখা করবো–
চলো। সুব্রতদা আমার হাত ধরে সিঁড়ির কাছে এলেন। দুধাপ উঠে আবার থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, কি বলবে ওকে?
-জানি না।
—আর কোনদিন আসবে না বলো?
—ও যদি না চায়, ও যদি বারণ করে…
—ও কি বোঝে? তোমাতে আমাতে কথা হচ্ছে–পুরুষ মানুষের ব্যাপার, মেয়েরা এসবের কি বোঝে?
—সুব্রতদা, আমাকে একবার ওপরে যেতে দিন।
আরও কয়েক ধাপ উঠে সুব্রতদা আবার দাঁড়ালেন। কি যেন উৎকর্ণ হয়ে শোনার চেষ্টা করলেন। মুখটা একটু বদলে গেল। খরগোসের মতন চোখ। তারপর আবার হাসলেন— ও কিছু না। সন্তু একটা কথা সত্যি করে বলো তো? তুমি কোনদিন গায়ত্রীর সঙ্গে…
—ছাড়ুন ছাড়ুন আমাকে। ঠেসে ধরেছেন কেন?
–সন্তু, তোমাকে যদি এই সিঁড়ি থেকে ঠেলে ফেলে দিই?
—কেন, আমি কি করেছি?
—তুমি কিছু করোনি। সেইটাই তো তোমার দোষ। তুমি একটি ন্যাকা—
—আমার কাঁধ ছাড়ুন। ভালো হবে না বলছি!
ইয়ার্কি করছি, তাও বোঝো না? তোমার কপালে রক্ত কেন? ব্রণ ফাটিয়েছো তুমি? দেখি, দেখি,–
—খবরদার, আপনি আমার কপালে হাত দেবেন না। না, বলছি—
—হাত দেবো কেন? রক্ত ছুঁতে আমার ঘেন্না করে। দেখছিলাম
নীচের দরজায় শব্দ হলো। সুব্রতদা আবার উত্তীর্ণ, সারা বাড়ির স্তব্ধতা ফাটিয়ে বিকট গলায় চিৎকার করে উঠলেন, কে? কে? দরজায় আবার শব্দ। আমাকে ছেড়ে বিদ্যুতের গতি, সুব্রতদা লাফিয়ে সিঁড়ি থেকে নেমে ছুটলেন। পিছনে পিছনে আমিও। দরজার সামনে গায়ত্রী দাঁড়িয়ে। সর্বাঙ্গ ভিজে, নতমুখ, চুল থেকে টপটপ করে জল গড়াচ্ছে। সিঁথির সিদূর গলে একটুখানি গড়িয়ে এসেছে নীচে। অনেকটা আমারই মতন রক্তাক্ত কপালের দৃশ্য। দরজায় হাত রেখে গায়ত্রী স্থির চোখে দেখলো দুজনকে। আমার চোখে চোখ রাখলো না। শরীরটা কাঁপছে ওর। আমি গায়ত্রীকে ডাকতে ভয় পেলাম। একদম মরতে ইচ্ছে করে না আমার। আমার খুব বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে।