–এখন না, একটু পরে।
–খাবার সব ঠাণ্ডা হয়ে গেল যে!
এবার মেয়েটি আমার দিকে ফিরে, আপনি একটু বসুন, বাবা এক্ষুনি ঘুরে আসছে। হঠাৎ আশা পেয়ে আমি মেয়েটিকে অনুনয় করি, দেখুন, আপনার বাবার সঙ্গে আমার আর কোনো দরকার নেই, আপনাদের এখানে কাছাকাছি কোনো বাথরুম আছে? আমি একটু মুখটা ধুতাম।
ডাক্তার চেঁচিয়ে বললেন, তার আগে একটা কথার উত্তর দিন। মেয়েটির সঙ্গে আপনার কতদিনের পরিচয়?
—আট ন বছর।
—নিশ্চয়ই মেয়েটি বিবাহিত?
–না, না,
—আবার মিথ্যে কথা? কাপুরুষ, কাপুরুষ! চোখের পাতা ফেলা দেখে বুঝতে। পারছি মিথ্যে কথা।
আমি মেয়েটিকে সনির্বন্ধ অনুরোধে, বাথরুমটা যদি দেখিয়ে দেন। —একতলার বাথরুম তো বন্ধ। পিসীমা গেছেন! দোতলায় আসুন
–না, না, থাক দোতলায় না। যদি একটু জল।
—শুধু জল চাই? বাইরে তো বৃষ্টি পড়ছে, তাতে ধুয়ে নিন না।
–বৃষ্টি পড়ছে?
–খুব জোরে। বেরুলেই ভিজে যাবেন।
—তা হোক, আমি চলি। অনেক ধন্যবাদ।
ডাক্তার তার মেয়েকে বললেন, রিস্টু, ঐ লোকটার অসুখ কোনোদিন সারবে না।–আমি আর ডাক্তারের কথায় বিন্দুমাত্র ক্রুক্ষেপ না করে বেরিয়ে এলাম সুইং ডোর ঠেলে। বসবার ঘর পেরিয়ে। বাইরে সত্যিই বৃষ্টি।
কিছুক্ষণ আগে যে ঘূর্ণী হাওয়া উঠেছিল, তারই অনুসরণকারী এই বৃষ্টি। বেশ কেঁপে এসেছে। আমি ভিজতে ভিজতে রাস্তার মাঝখানে। দু’হাত পেতে জল নিয়ে হাত দুটো রগড়ে নিলাম। আকাশের দিকে মুখ রাখতেই কিছুক্ষণ সচ্ছলভাবে জলবর্ষণ হলো, ব্রণ থ্যাঁৎলানো জায়গাটা জ্বালা করে উঠলো। একটা ট্যাক্সির জন্য আমার মনপ্রাণ আকুল।
.
৩.
অফিস ছুটির পর যে রাস্তাঘাট মানুষে ছেয়ে যায়, সেসব মানুষ এখন কোথায়? খাঁ খাঁ করছে চৌরঙ্গি। জলে ভেজা রাস্তার ওপর দিয়ে যাওয়া গাড়ির চিটচিটে শব্দ। অন্য দু একটা গাড়িবারান্দার নীচে কিছু লোক জমে আছে, কিন্তু বাইবেল সোসাইটির বাড়ির বারান্দার নীচেটা সম্পূর্ণ ফাঁকা। কেউ নেই। সাড়ে ছটা বাজে। গায়ত্রী এসে চলে গেছে? এই বৃষ্টির মধ্যে গেল কি করে? বুকের মধ্যে একটা বিষম উত্তেজনা। কোনোদিন গায়ত্রীর বাড়িতে গিয়ে দেখা করিনি। কিন্তু আজ গায়ত্রীর সঙ্গে আমার। দেখা করতেই হবে। ট্যাক্সিটা ঘুরিয়ে নিতে বললাম।
ট্যাক্সি স্টার্ট নেবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলাম ফুটপাতের ধার ঘেঁষে গায়ত্রী হাঁটছে। বসন্তকালের আকস্মিক বৃষ্টি, কেউ ছাতা বা বর্ষাতি নিয়ে বেরোয়নি, সুজাং পথে লোক নেই। গায়ত্রী একা হাঁটছে ভিজতে ভিজতে মিউজিয়ামের পাশের প্রশস্ত ফুটপাতে। মন্থর, অভিমানী তার পদক্ষেপ। কষ্ট হলো, গায়ত্রী আমাকে ভুল ভেবেছে। বৃষ্টির ভয়ে আমি আসিনি। তাইও ইচ্ছে করে বৃষ্টিতে ভিজছে। ট্যাক্সিওলা, রোখকে। গায়ত্রী!
দরজা খুলে আমি অতি ব্যস্ততায় নেমে পড়েছি। এবার সে ঘুরে তাকালো। গায়ত্রী নয়। লম্বাটে ধরনের মুখ, অতিরিক্ত ফর্সা, কিন্তু সেই মুখ বিষণ্ণ ছিল। অন্য মেয়ে কিন্তু একটু একটু চেনা মনে হলো। ডাক্তারটিকেও একটু চেনা মনে হয়েছিল, কোথাও যেন আগে দেখেছি, কিন্তু মনে করতে পারিনি। এরও নাম মনে এলো না। কিন্তু মেয়েটি আমাকে চিনতে পেরে বললো, সনবাবু? আপনি কোনদিকে যাচ্ছেন? আমাকে একটু বেকবাগানের মোড়ে পৌঁছে দেবেন? একটাও ট্যাক্সি পাচ্ছি না— সাড়ে ছটার মধ্যে পৌঁছুরার কথা।
আমি খিদিরপুরের জন্য রওনা হয়েছিলাম, বেকবাগান অন্যদিকে। কিন্তু না বলা যায় না। আসুন। সঙ্কুচিতভাবে আমি সরে বসলাম। মেয়েটি হাতব্যাগের মধ্যে থেকে শুকনো রুমাল বার করে মুখ মুছতে মুছতে, ভাগ্যিস আপনার সঙ্গে দেখা হলো। সাড়ে ছ’টা এখানেই বেজে গেছে!
আমার একমাত্র সৌভাগ্য, আমি একটা ট্যাক্সি অধিকার করতে পেরেছি মেয়েটিকে তার ভাগ দিতে হবে। কিন্তু কে এই মেয়েটি? বেকবাগানের দিকে দ্রুত ধাবমান ট্যাক্সির দশ মিনিটের মধ্যে মেয়েটির কাছ থেকে আমার যে ওর নাম মনে নেই সে কথা বুঝতে না দিয়ে, ওর নাম কি করে জানা যায়? জিজ্ঞেস করি, গায়ত্রীর সঙ্গে আপনার দু’চারদিনের মধ্যে দেখা হয়েছিল?
—কে গায়ত্রী?
—গায়ত্রীকে চেনেন না? গায়ত্রী সান্যাল?
–না তো।
—আপনি আমাকে চিনলেন কি করে?
—ও না, আপনি বুঝি আমায় চিনতে পারেন নি?
–না।
—তাহলে একটা অচেনা মেয়েকে ট্যাক্সিতে তুললেন কেন?
—আপনি তো আমার নাম ধরে ডাকলেন।
—শুধু সেইজন্যই? আপনি-কোনদিকে যাচ্ছিলেন?
–খিদিরপুর।
–তাহলে বেকবাগানে যাচ্ছেন কেন?
—তাতে কি হয়েছে, আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি।
–না, আমি যাবো না, আমাকে এখানেই নামিয়ে দিন।
—আরে না, না, তা কি হয়? চলুন না, বেকবাগান আর কতদূরে।
–না, আমি কিছুতেই যাবো না। আপনি আমার নাম জানেন না?
—আপনি কি করে জানলেন যে আমার নাম সনৎ?
—সেটা আপনার দেখার দরকার নেই। ট্যাক্সি, এখানে বেঁধে দিন!
—আরে একি করছেন! চলুন না, এইটুকু তো পৌঁছে দেওয়া।
মেয়েটি দরজা খুলতে গেলে, আমি হাত বাড়িয়ে তাকে বাধা দেবার চেষ্টা করি। মেয়েটি হিংস্রভাবে মুখ ঘুরিয়ে আপনি আমার গায়ে হাত দিচ্ছেন যে? লজ্জা করে না? একটা অচেনা মেয়ের…
—আরে ছি ছি, তা নয়। আমি আপনাকে পৌঁছে দিতে চাইছিলাম।
একটা অচেনা মেয়েকে পৌঁছে দেওয়ার অত গরজ কিসের আপনার?
—অচেনা কোথায়? আপনি তো আমাকে চেনেন।