নাকের কাছটা হঠাৎ ভিজে লাগলো। একটা ফোঁটা টলটল করছে। হঠাৎ সর্দি হয়ে গেল? ছিটেফোঁটাও তো ছিল না সকালে? আঙুল ছোঁয়ালুম। আঙুলের ডগা রক্ত মেখে ফিরে এলো। এখনও রক্ত। এবারে আঙুল গেল কপালে, খুব সবধানে ছুঁল। ভিজে ভিজে। মলম লাগিয়েও রক্ত বন্ধ হয়নি। রুমালটায় ছাপ ছাপ রক্ত। আমার হাতে। তাহলে নিশ্চিত মুখেও। ভালো করে না ধুয়ে তো যাওয়া যাবে না। এক একটা ব্রণ এরকম তেরিয়া ধরনের হয়, কপালের ব্রণ তো কোনো নিয়মই মানে না। অনেক ডাক্তারের ঘরে হাত ধোওয়ার জন্য বেসিন থাকে। এঁর নেই। আয়নাও নেই। এই প্রথম আমার মন খারাপ লাগলো। গায়ত্রীর কাছে এরকম রক্তমাখা হাত আর মুখ নিয়ে কুৎসিত ভাবে কি করে যাবো? আর কপালের রক্তপাত বন্ধ করতেই হবে।
ডাক্তার মাইক্রোসকোপে তন্ময়। আমি ক্রমশ অধৈর্য। মলমের টিউবটা কোথায় গেল। আমি একটু জোরে বললুম, মলমটা আর একটু দেবেন? আমার রক্ত বন্ধ হয়নি। মাইক্রোসকোপ থেকে চোখ উঠলো না, উত্তর এলো বেশী মলম লাগালে বেশী কাজ হয় কে বলেছে?
—কিন্তু আমার রক্ত পড়া তো বন্ধ করতে হবে।
–বললুম তা, ঐ চেয়ারটায় বসুন!
ঘরের ভেতর দিকে আর একটা দরজা আছে, আগে লক্ষ্য করিনি। খোলর পর চোখে পড়লো। খোলা দরজায় একটি মেয়ের শরীরের এক অংশ দাঁড়ালো। মুখ ঝুঁকলো ঘরের মধ্যে, কোঁকড়া চুল, চিবুক দেখলে উনিশ বছরের বেশী বয়েস মনে হয় না। ভারী চমক্কার দাঁত, সেই দাঁতের ঝিলিকে প্রশ্ন, বাবা, তুমি এখন চা খাবে?
–না।
—আবার তৈরী হয়ে গেছে।
–এখন না একটু পরে।
মেয়েটিকে দেখেই আমি মুখটা ফিরিয়ে নিয়েছিলাম। রক্ত মেখে আমার কপালের চেহারাটা এখন কি রকম হয়ে আছে কে জানে। কিন্তু মেয়েটি ঘরের দ্বিতীয় প্রাণীর উপস্থিতি ক্ষেপই করলো না, সম্পূর্ণ শরীরটা নিয়ে ঘরে এলো, দোহারা চেহারা, পুঁতে রঙের শাড়ি, আমি আড়চোখে দেখছি, সে টেবিল থেকে দুটো আলপিন তুলে নিয়ে আবার পিছনের দরজা দিয়ে চলে গেল।
ডাক্তার চোখ তুলে সাড়ম্বরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মুখখানা কিন্তু সত্যিকারের বিষাদময়। ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে বললেন, জানতুম! আমি আগেই জানতুম।
আমার বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে উঠলো। এতক্ষণ ধরে আমার রক্তে কি দেখছিলেন। কি হয়েছে আমার? রক্ত পড়া থামছে না কেন? নাঃ এসব বাজে ভয়। ‘জানতুম’। কি জানতেন? দরকার নেই জেনে। মলমটা বিনা পয়সায় হলেও রক্ত পরীক্ষার জন্য ফি দিতেই হয়।
—দেখুন, আমার রক্তটা বন্ধ হচ্ছে না। দয়া করে এর একটা ব্যবস্থা করবেন?
—ঐ রক্ত শরীরে থেকেই বা লাভ কি? যতটা বেরিয়ে যায় যাক।
–তার মানে? আমি রাস্তা দিয়ে এভাবে যাবো কি করে?
—যেতে হবে না। সেইজন্যই তো ঐ চেয়ারে বসতে বললুম।
—আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে যে।
–কোথায় যাবেন?
অচেনা লোককে কেউ এ প্রশ্ন করে না। ডাক্তারটা আসল তো? নাকি কোনো পাগল? একটা ব্রণ ফাটার রক্তও তত বন্ধ করতে পারে না। জলের ঝাপটা দিতে পারিলে রং।
—আমার রক্তে কি দেখলেন?
—আমার এই ক্যাবিনেটে সাতশো রক্তের স্লাইড আছে। ওর সব কটাতে যা দেখছি, আপনারটাও তাই। দুষিত, পচা রক্ত।
—অসম্ভব, আমার কোনো অসুখ নেই।
—আসল অসুখটাই বাধিয়ে বসে আছে। ঐ সাড়ে সাতশো— প্রত্যেকেরই বয়েস তিরিশের নীচে সকলেরই এক রোগ।
অস্বীকার করতে পারবো না, ভয়ে বুকটা ছমছম করছে। অজান্তে কোনো মারাত্মক অসুখ শরীরে দানা বেঁধেছে? কখনো তো টের পাইনি। হঠাৎ একদিন মূল ধরে নাড়া দেবে? মরে যাবো? মৃত্যুর কথা ভাবলে বুক মোচড়ায়। না, মরতে চাই না। একটুও মরতে ইচ্ছে হয় না।
পূর্ব নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে আমার শরীর। মুখ প্রশ্ন করে, কি অসুখ?
—এক্ষুনি যেতে হবে বলছিলেন যে?
—অসুখটা কি বলুন। পরে এসে আপনার কাছে চিকিৎসার ব্যাপার…
—কি নাম?
–সনৎ দাশগুপ্ত।
–বয়েস?
–সাতাশ।
—অসুখটার নাম কাপুরুষতা।
ডাক্তারের ঠিক দু’চোখের ওপর আমার দুচোখ। দেখছি। দেখা হয়ে গেল। লোকটা নিশ্চয়ই বাতিকগ্রস্ত। কিংবা আদর্শবাদী টাদী কিছু একটা হবে। গুরুত্ব দেবার দরকার নেই। উঠে দাঁড়িয়ে সামান্য হেসে বললুম, আচ্ছা চলি। সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়লো, রক্তটা ধুতে হবে। কপালে, নাকে, হাতে। এইরকম ভাবে রাস্তায়–।
ডাক্তারও উঠে দাঁড়িয়েছেন, প্রায় হুংকারের মত বললেন, অস্বীকার করতে পারবেন, কাপুরুষতার কথা। আমার বয়েস সাতচল্লিশ, আমার সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার সাহস আছে?
পাঞ্জা লড়ার ভঙ্গিতে নিজের কজি মুচড়ে দিলেন তিনি, ঘড়িটা একেবারে আমার চোখের সামনে। ছটা বাজতে পাঁচ। আঃ, কেন তিনটে বাস ছেড়েছিলাম। কেন প্রতাপ কাকা। কেন গয়লাটার কনুই। এখনও ট্যাক্সী নিতে পারলে–চঞ্চল হয়ে বললুম, দেখুন, আজ আমায় এক্ষুনি যেতে হবে, পরে আর একদিন এসে আপনার সঙ্গে কথা বলবো। এখন একটু যদি।
—এক হাত পাঞ্জা লড়ারও সাহস নেই?
—আমার এক্ষুনি যেতে হবে। যদি একটু…
কতক্ষণ আর লাগবে? এক মিনিট।
–কিছুতেই আর পারবো না। যদি একটু জল—
—কোথায় যেতে হবে?
—একটি মেয়ে ছটার সময় দাঁড়িয়ে থাকবে, ভীষণ দেরী হয়ে গেছে, কিন্তু রক্তটা বন্ধ হলো না
—মেয়েটির সঙ্গে কতদিনের পরিচয়?
পিছনের দরজা ঠেলে আবার সেই মেয়েটি। সেই পুঁতে রঙা শাড়ি, দোহারা উনিশ। এবারও ঘরের তৃতীয় ব্যক্তিকে অগ্রাহ্য করা গলায়, বাবা, তোমাকে মা ডাকছে