আমি ধরা গলায় বললুম, না, না—
–খুব ভালো গন্ধ। রিফুজি মেয়েদের তৈরী করা, দু’প্যাকেট নিন, সাত আনায় হবে—
–না, না,
–গরীব মেয়েগুলো রোজগারের চেষ্টা করছে একটু সাহায্য করুন।
আমি কাতরভাবে জানালুম না, ভাই আমি ধূপকাঠি নেব না। এখানে ডাক্তারখানা কোথায় বলতে পার?
—ও কিছু না, একটু চুন লাগিয়ে নিন্—
না, চুন লাগাবো না—ডাক্তারখানা–
লোকটি নির্লিপ্তের মতন জানালো, কি জানি, ডাক্তারখানা কোথায়?
কী নিষ্ঠুর লোকটা। এই কি আমার ধূপকাঠি কেনার সময়। আমি ধূপকাঠি কিনিনি বলে আমাকে ও ডাক্তারখানা দেখাবে না। রাস্তাটার দু’ধারে শুধু পোশাক আর মনোহারী জিনিসের দোকানই চোখে পড়ে। কিন্তু ডাক্তারখানা বা ওষুধের দোকান একটা কোথাও থাকবেই লুকিয়ে।
কাপড়ের দোকানে সিঁড়িতে এক ধাপ উঠে এতক্ষণে আমার গায়ত্রীর কথা আবার মনে পড়ে। গায়ত্রী দাঁড়িয়ে থাকবে। সুতরাং গলায় সোনার চেন-পরা মলমলের পাঞ্জাবী গায়ে লোকটিকে ডাক্তারের কথা জিজ্ঞেস করার আগে আমি প্রশ্ন করলাম, এখন কটা বাজে।
লোকটি আঁৎকে উঠে বললো, এ কি, আপনার সারা মুখে রক্ত! মাথা ফেটে গেছে বুঝি? ওরকম রুমাল চেপে দাঁড়িয়ে আছেন? হাসপাতালে যান ট্যাক্সী ডেকে দেবো?
অবিচলিতভাবে পুনরায় আমার প্রশ্ন, এখন কটা বাজে?
–এমারজেন্সি সব সময় ভোলা। কি করে ফাটলো?
–কটা বাজে আগে বলুন!
–সাড়ে পাঁচটা।
—আপনার ঘড়ি ঠিক আছে? শ্লো নয় তো?
লোকটি গলা ছেড়ে কাকে ডাকলো, হেরম্ব, এদিকে এসো তো একবার বাণ্ডিলটা নামিয়ে রেখে এসো!
এখনও সময় আছে। ব্যথার জন্য মনে হয়েছিল অনেক সময় কেটে গেছে। বললুম, আমার বিশেষ কিছু হয়নি, একটা ফোড়া ফেটে… এখানে ওষুধের দোকান কিংবা ডাক্তারখানা আছে?
–বাঁ-দিকে চলে যান, পাঁচ সাতখানা বাড়ি পরে একজন ডাক্তার থাকেন। এ হে, মেঝেতে রক্ত পড়লো, হেরম্ব, জল নিয়ে এসো— বললুম না— বাণ্ডিলটা নামিয়ে রেখে এক্ষুনি একবার এদিকে এসো—
কপাল থেকে রুমালটা সরাতেই রক্ত আবার গলগল করে বেরুতে চায়। পুনরায় রুমাল চাপা। কাপড়ের দোকানের মেঝেতে পাতা দু ফোঁটা রক্ত। ছটা বাজতে এখনো দেরী।
পাঁচখানাও না, সাতখানাও না, আমি শুনতে শুনতে আসছিলাম, ঠিক একুশখানা বাড়ির পর এক বাড়িতে এক ডাক্তারের নেম প্লেট। বেল টিপতেই আর্দালি। আসুন ভেতরে। এখানে একটু বসুন। আমার খুব তাড়াতাড়ি আছে। আর্দালি সুইং দরজা ঠেলে অপর কক্ষে ঢুকে গেল, তখুনি বেরিয়ে এসে বললো, আসুন।
.
২.
টেবিলের ওপর কনুইয়ের ভর দিয়ে ডাক্তারটি কোনো বই পড়ছিলেন। চোখ তুলে আমাকে দেখেই বললেন, কি? স্টাবিং?
আমি বিনীতভাবে বললুম, না, হঠাৎ একটা ব্রণ ফেটে গেছে–
বিনীত, কেননা, এর আগের মুহূর্তেও ডাক্তারের ফির কথা মনে পড়েনি। আমার দরকার শুধু অ্যান্টিসেপটিক মলম–কিন্তু এই ডাক্তারের সময় নষ্ট করার জন্য যদি। কত? আট, যোলো বত্রিশ? পকেটে নি টাকা। ঘরখানায় আলো খুব জোরালো নয়, এত বেশী চামড়া বাঁধানো বই যে ডাক্তারের বদলে উকিলের ঘর বলে ভুল হয়। আরো চোখে পড়ে, তিনদিকের দেয়ালে প্রায় পনেরো-যোলোটা টিকটিকি, বেশ কেঁদো সাইজের।
ডাক্তার এবার বেশ ধীরে সুস্থে তিনটে ড্রয়ার খুঁজে একটা মলমের টিউব বার করলেন। সেটা হাতে রেখেই একটা আলমারি খুললেন। আলমারি ভর্তি থাকে থাকে সাজানো কাঁচের স্লাইড। অন্তত হাজার দুয়েক। তার থেকে একটা স্লাইড নিয়ে আমার কাছে এগিয়ে এলেন। আমি তখনও দাঁড়িয়ে। কাছে আসার পর আমার মনে হলো, এই ডাক্তারকে আমি আগে কোথাও দেখেছি। কোথায়? মনে নেই। কুমের সুরে তিনি বললেন, রুমাল সরান। সরে গেল। কাঁচের স্লাইডে তিনি আমার কপাল থেকে এক ফোঁটা রক্ত নিলেন। তারপর রক্তটার দিকে নিৰ্ণিমেষে চেয়ে রইলেন। যেন ওঁর খুব দুঃখ। এইভাবে মানুষ কখনো কখনো প্রথম দেখা নদীর দিকে তাকায়। ডাক্তারের হারে কজীর ঘড়িতে দেখে নিলাম— পাঁচটা চল্লিশ, আর বেশী সময় নেই। বাসে এখান থেকে পনেরো মিনিট লাগবেই মেরে কেটে। আমি অধৈর্য হয়ে উঠছিলাম। খালি চোখে রক্তে আবার কে কি দেখতে পায়। ভড়ং! ফি-তো দিচ্ছি না! এই ডাক্তারকে আগে কোথায় দেখেছি? ডাক্তার এবার মুখ ফিরিয়ে আবার হুকুম, আঙুল দেখি!
আঙুলগুলো ছড়িয়ে হাতের পাঞ্জাটা এগিয়ে দিলাম। ডাক্তার টিউব টিপে একটুখানি মলম আমার তর্জনীতে লাগিয়ে ডান দিকের একটা হেলানো চেয়ার দেখিয়ে বললেন, যান, ঐখানে বসে কপালে মলমটা লাগান।
চেয়ারে বসার কোনো ইচ্ছেই নেই আমার, সময় নেই, অতএব আরও বিনীত, বিগলিত হাস্যময় মুখ, না, আমি আর বসবো না, আমাকে এক্ষুনি একটা কাজে যেতে হবে। অনেক ধন্যবাদ, মানে একটাও ওষুধের দোকান নেই কাছাকাছি, তাই আপনাকে বিরক্ত করতে হলো, মলমটা–
–বসুন ঐ চেয়ারে!
অবাক। হুকুম? কেন, কি এমন ব্যাপার হয়েছে? ভারী তো একটু মলম, এ ডাক্তারের কাছে তেমন পেসেন্টও তো আসে না। রথীনের মামার চেম্বারে দেখেছি সব সময় কানা খোঁড়ায় গিসগিস করে। বসলুম না, দাঁড়িয়েই রইলুম। ডাক্তার চলে গেছেন টেবিলের ডান পাশে, মাইক্রোসকোপের নিচে আমার রক্তমাখা স্লাইড, মাইক্রোসকোপের ওপরে ডাক্তারের মনোযোগী চোখ। চোখ না তুললে কথা বলতে পারছি না। এবারের কথাটা ডাক্তারের চোখের দিকে চোখ রেখে নির্ভীক ভাবে বলতে হবে। উপকার করেছেন ঠিকই কিন্তু এমন কিছু নয়, যার জন্যে আপনার স্কুম শুনতে হবে! এর জন্যে ফি আশা করাও আপনার অন্যায়।