চন্দন কিংবা চুন কিংবা স্টিকিং প্লাসটার লাগাবার কথা আমি ভাবতেই পারি না। তাহলে প্রথমেই চোখে পড়ে, চোখের সামনে ক্যাট ক্যাট করে। কপালের ঠিক মাঝখানে ঐ দৃশ্যমান কলঙ্ক নিয়ে নিয়ে রাস্তায় হাঁটা আমার সম্ভব নয়। চোদ্দ বছর বয়স থেকে যার ব্রণ উঠছে, সেই লোকেরও আজ কপালের ওপর একটা মাত্র ব্রণ ওঠায় সত্যিকারের মন খারাপ হলো। আমি গোটা তিনেক দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। অন্তত আজকের দিনটায় ওটা না উঠলে হতো না! দেড় মাস পর আজ গায়ত্রীর সঙ্গে দেখা হবে। হঠাৎ দেবনাথের কথা মনে পড়ায় আমার বেশ রাগ হলো। বন্ধুদের মধ্যে দেবনাথকেই সবচেয়ে সুন্দর বলা চলে। কোঁকড়ানো চুল, ধারালো নাক আর ঠোঁট ঝকঝকে চামড়া, সব কিছুর সঙ্গে দামী করে গ্লাসের মিল আছে। ঐ রকম সুন্দর মুখ নিয়ে এখন দেবনাথ খবরের কাগজের অফিসে যুদ্ধের ইংরেজি খবরের বাংলা অনুবাদ করছে। অন্তত আজ বিকেলে ঐ কাজের জন্য দেবনাথের অমন সুন্দর মুখের কোনো দরকার ছিল না। আমার ছিল।
চৌরঙ্গীর ওপর, লিণ্ডসে স্ট্রীট ছাড়ালে বাইবেল সোসাইটির বাড়ি–যেখানে একটা কাঁচের বাক্সের মধ্যে বাইবেল খোলা অবস্থায় রাখা থাকে–প্রতিদিন কে বা কারা তার একটি করে পাতা উল্টে দেয়, সেই বাড়ির বারন্দার নিচে গায়ত্রী এসে দাঁড়াবে ঠিক ছটার সময়। আমি একটু আগেই বেরিয়েছিলাম। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই গায়ত্রী কোনোদিন আসে না, সুতরাং ওখানে আমাকে বহুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবেই–তাই বাসে ওঠার আগে আমি আর একটা সিগারেট ধরালাম। সেই আমার। প্রথম ভুল। ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে যারা মরে, তাদের অনেকেরই বোধহয় আগের ট্রেনে যাবার কথা থাকে।
সিগারেটটা মুখে রেখে দেশলাই জ্বেলেছি, কে যেন ফু দিয়ে সেটা নিবিয়ে দিল। তাকিয়ে দেখি কেউ না। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া উঠেছে, পাক দিয়ে ঘুরছে ধুলো। চোখ আড়াল করলুম আমি ধুলো আটকাবার জন্য। বিকেলবেলা এরকম হাওয়া ওঠা ভাল নয়, বিকেলটা না নষ্ট করে দেয়। কিছুতেই সুযোগ হয় না, গায়ত্রী অনেক চেষ্টা করেও আসতে পারে না, লুকিয়ে দেখা করতে হয়। আজ দেড় মাস পরে আমি। গায়ত্রীকে সান্ত্বনা দেবো এবং সান্ত্বনা চাইবো। একটু পরেই চোখ খুলে দেখি, সেই ঘূর্ণী ঝড়টা উঠে গেছে শূন্যে, রাস্তা আবার আগের মতন শান্ত এবং রাস্তার উল্টো দিক থেকে আমারই জন্য একজন হেঁটে আসছে। সিগারেটটা ধরিয়েই আবার ফেলে দিতে হলো; কেননা, বাবার বন্ধু প্রতাপ কাকা। প্রতাপ-কাকা বললেন, রাস্তার ওপার থেকে তোকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিলুম, তুই দেখতে পাসনি সন্তু?
আমি বিস্ময়ের ভাব ফুটিয়ে বললুম, না তো আপনি আমাকে ডাকছিলেন?
-হ্যাঁ, তোদের বাড়িতে আমাকে যেতে হতো ভালোই হলো তোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তোর মা-কে বলিস্… কপালের ওপর তোর ওটা কি হয়েছে? অড় ফেঁড়া?
–ফোঁড়া না, ব্রণ, এমন কিছু নয়—
–না, না কপালের ওপর ওরকম প্রকাণ্ড একটা, শোন্, আঙুলে রুমাল পেঁচিয়ে তারপর টিপে দে এমনি করে—
–না, না, প্রতাপ কাকা বিষম ব্যথা–
—আচ্ছা শোন, তোর মাকে বলিস…
প্রতাপ কাকা যতক্ষণ কথা বললেন, ততক্ষণে দুটো বাস চলে গেল বেশ ফাঁকা ফাঁকা। তখন বুঝতে পারিনি— সেই দুটি বাসই আমার সমস্ত সৌভাগ্য নিঃশেষ করে নিয়ে যাচ্ছে। ঐ দুটোর যে-কোনো একটায় উঠলে—।
তৃতীয় বাসে বেশ ভীড়, কিন্তু না উঠে উপায় নেই— এরপর দেরী হয়ে যাবে। পা দানিতে সিঁড়ির কাছে। একজন পাঞ্জাবি গোয়ালা সিঁড়ির নিচে দুধের বালতিটা রেখে আমার পাশে। সম্রাটের মতন তাঁর দাড়িময় মুখের সৌষ্ঠব। কিন্তু গায় খুব বদগন্ধ। দুটি মেয়ে নেমে যাবার আগে আমার দিকে বার বার ফিরে ফিরে তাকায়। বস্তুত ওরা আমার ব্রণের জন্যই তাকিয়েছিল, কিন্তু ওদের সেই চাহনিই আমাকে ব্রণের কথা ভোলাবার পক্ষে যথেষ্ট এবং আমাকে অমনোযোগী করে। কিছুক্ষণের জন্য গায়ত্রীর কথাও আমার মনে থাকে না। সেই অবসরকালে, কণ্ডাক্টর টিকিট চাইতে এলে, আমার তো পয়সা হাতেই ছিল, অন্যমনস্ক হাত দেওয়া-নেওয়া সেরে নেয়, পাঞ্জাবী গয়লাটি কোমরের গেঁজের গিট খোলার চেষ্টা করে। হয়তো অসতর্ক মুহূর্তে আমি মুখ ঘুরিয়েছিলাম, কিংবা তার হাত পিছলে গিয়েছিল, অব্যথভাবে গয়লাটির কনুই আমার কপালে আঘাত করে। তৎক্ষণাৎ প্রথমেই আমার মনে হলো আমি অন্ধ হয়ে গেছি— এমনই তীব্র যন্ত্রণা এর থেকে বেশী শারীরিক যন্ত্রণা আমি আগে কখনো পাইনি। অস্পষ্ট ভাবে কানে এলো, মাফ কিজিয়ে, নেই দেখা, বিলকুল… খুন গিরতা। মনের মধ্যে বিদ্যুভাবে খেলে গেল গয়লার ময়লাসঙ্গী হাত, কতরকম বীজাণু, সেপটিক, ইরিসিপ্লাস, অরুণেশ দাস মজুমদার। কপালে রুমাল চেপে আমি বাস থেকে নেমে পড়লুম।
ব্যথা একটু কমতেই চিন্তা স্বাভাবিক হয়ে আসে, মনে হয়, মৃত্যু অত সোজা নয়। এখন চাই একটা আয়না কপালের ক্ষত কতখানি। সিগারেট কেনার জন্য এক টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে পানের দোকানের মহাভারতের ছবি আঁকা ক্যালেণ্ডারের পাশের ঝাপসা আয়নার সামনে আমার মুখ। একেবারে থেতলে গেছে ব্রণটা, এখনও রক্ত বেরুচ্ছে। এক একটা ব্রণ এই রকম অভিমানী— অসময়ে ফাটালে কিছুতেই রক্তস্রোত বন্ধ করতে চায় না। পানওয়ালা সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বললো, বাবু, ধূপকাঠি কিনবেন। আমার কাছে ভাল ধূপকাঠি আছে—