কড়িকাঠ থেকে সম্পূর্ণার দেহটা বিবেকদাস দ্রুত হাতে টেনে নামিয়ে নিল। ডেডবডিটাকে একটা বস্তায় পুরে মুখটাকে ভালো করে বেঁধে নিল, তারপর বস্তাটাকে কাঁধে ফেলে অন্ধকারেই বাইরে বেরিয়ে এল।
রাত তখন দশটা বাজে। কাছেই একটা পাতকুঁয়ো ছিল। বস্তা সমেত দেহটাকে পাতকুয়োয় ফেলে দিয়ে অ্যাদ্দিনকার পুরনো গ্রাম ছেড়ে চিরদিনের মত হারিয়ে গেল।
.
৩.
এই ঘটনার পর প্রায় এক বছর কেটে গেছে। ময়নাগুঁড়ি গ্রামের লোকেরা বিবেক দাস আর সম্পূর্ণার কথা প্রায় ভুলেই গেছে।
সেবারও পূজোর টাইম। দিনটা শুক্রবার।
ময়নাগুঁড়ি গ্রামের বারোয়ারি পূজো মণ্ডপের সামনে বেশ কিছু লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিসর্জন দেখছে।
আজ বিজয়া দশমী। বিকেল থেকেই টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে।
সেই সময় অন্ধকার রাস্তা ধরে একজন লোক ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল। তার পরনের পোষাকটা এখানে ওখানে ছিঁড়ে গেছে। মুখে একগাল কাঁচা পাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথায় এলো-মেলো রুক্ষ চুল। এই মুহূর্তে ওকে দেখলে মনে হবে যেন অনুশোচনার আগুনে পুড়ে বুকটা একেবারে ছাই হয়ে গেছে।
একটু দূরেই একটা ফাঁকা মাঠ। মাঠের ধারেই একটা বড় পাতকুঁয়ো। লোকটা সেখানে গিয়ে থেমে গেল।
গাঢ় অন্ধকারের বুকে পাতকুয়োর ধারটা সেই মুহূর্তে নির্জন হয়ে আছে। সেইসঙ্গে খেপে খেপে অনেক দূর থেকে ঝিঝির ডাক শোনা যাচ্ছে।
লোকটা হঠাৎ হাত দুটো জোড় করে আকাশের দিকে তুলে ধরে কার কাছে ক্ষমা চাইল। একটু পরে নিচু হল। কুঁয়োর পাড়ে মাথা নেড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদল, পরমুহূর্তেই একটা ভয়ঙ্কর কাণ্ড
কুঁয়োর গভীরে একটা ঝপাং শব্দ হল। তারপর একটা ভারী দেহের পতন ও চাপা আর্তনাদের সঙ্গে সঙ্গে কুঁয়োর আশপাশটা নির্জন হয়ে গেল।
.
পরদিন সকাল।
সকালবেলার টাটকা রোদে চারিদিক ঝলমল করছে।
বেলা যখন একটা, সেইসময় দুপুরের দিকে একটা তীব্র পচা গন্ধে পাতকুঁয়োর আশপাশটা ভরে গেল।
গীর্ঘ এক বছর বাদে কুঁয়োর ধার থেকে আবার পচা গন্ধ পেয়ে গোটা তল্লাটে যেন আলোড়ন পড়ে গেল।
বিকেলের দিকে কুঁয়োর জলে একটা মৃতদেহ ভেসে উঠল। ভেসে ওঠা দেহটা যখন টেনে তোলা হল, দেখ গেল দুর্গন্ধময় দেহটা আর কারো নয়। সম্পূর্ণার স্বামী অর্থাৎ বিবেক দাসের মৃতদেহ।
দেহটা জলে ভিজে ফুলে গেছে। চোখ দুটো অনুশোচনায় ভরে গেছে। ঢল ঢলে চোখের চাউনি দিয়ে সে যেন বলতে চাইছে, সম্পূর্ণা, যদি পার—আমাকে তুমি রুমা কোরো।
সন্ধ্যেবেলা রক্তপাত – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
আগের দিন সন্ধ্যেবেলাতেই একটু একটু সন্দেহ হয়েছিল, সকালবেলা উঠে দেখলুম, আমার কপালের ঠিক মাঝখানে একটা ব্রণ উঠেছে। সাদা টুসটুসে, ব্যথা কি! আয়নায় দেখা গেল আগুনের শিখার মতন, কাছাকাছি হাত নিয়ে যেতে ভয় হয়। আমার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো।
হয় এরকম আমার মাঝে মাঝে। গালে, থুতনিতে। সবচেয়ে বিরক্তিকর লাগে ঠোঁটের কোণায় হলে। সেই চোদ্দ-পনেরো বছর থেকে শুরু হয়েছে। বড় পিসীমা সে সময় বলতেন, ও কিছু না, বয়েস ফোড়া, সময়কালে সেরে যাবে। কি জানি বড় পিসীমা সময় বলতে কি বুঝিয়েছিলেন, সাতাশ বছর বয়েস হলো, এখনও আমার নিষ্কলঙ্ক মুখের সময় আসেনি? বড় পিসীমা যেদিন মারা যান, সেদিন দাড়ি কামাতে গিয়ে একটা ব্রণ কেটে ফেলায় রক্তই বেরিয়েছিল আমার, খুব মনে আছে।
ব্ৰণ আমার গা সহা হয়ে গেছে। সাদা হয়ে এলেই আমি দেশলাই জ্বেলে একটা সেফটি-পিন পুড়িয়ে প্যাট করে গেলে দিই। ভেতরের সাদা জিনিসটা টিপে বার করে দিলে চুপসে যায়, তখন আর অতটা চোখে পড়ে না। নইলে, মুখের ওপর পাকা ব্রণ থাকলে অনেকে ভালো করে আমার মুখের দিকে তাকাতে চায় না কথা বলতে বলতে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আমি নিজে তো দেখেছি–অন্য কারুর মুখ ভর্তি ব্রণ দেখলে আমার গা বমি বমি করে, তাকাতে ইচ্ছে করে না।
কপালের ওপর ব্রণ, এতে একটা সুবিধে হয়েছে অবশ্য, দাড়ি কামাতে অসুবিধে হবে না, কেটে যাবার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এ ব্ৰণ গেলে দেওয়াও যাবে না। কপালের ওপর ক্ষত তৈরী করতে নেই— এটা শুধু কুসংস্কার নয়— দারুন সেপটিক হয়ে যেতে পারে। ইরিসিপ্লাস না এই ধরনের কি যেন একটা অসুখ আছে–অরুণেশ দাস মজুমদার বলে একটা ছেলে আমাদের সঙ্গে কলেজে পড়তো, তিনদিনের ছুটিতে মেদিনীপুরের দেশের বাড়িতে গেল— আর ফিরলো না, বৌদির শেলাইয়ের সূঁচ দিয়ে কপালের ব্রণ গেলেছিল। অরুণেশ হঠাৎ মরে গেল বলেই সেবার আমি ম্যাগাজিন এডিটর হতে পেরেছিলাম। যতই খারাপ দেখাক, কপালের ব্রণ আমি গালতে পারবো না। কিন্তু আজ গায়ত্রীর বুকে আমার কপাল সমেত মুখখানা একবার চেপে ধরবো ভেবেছিলাম।
গায়ত্রী ব্রণ দেখলে কখনো ঘেন্না করে না, অন্তত সে রকম কোনো ভাব কখনো দেখায়নি। বরং গায়ত্রী আমার জন্য নিত্যনতুন ওষুধ কিনে আনে। শাঁখের গুঁড়ো হজমের ওষুধ হরেক রকম মলম। গায়ত্রীর মসৃণ মুখের চামড়া, একটা দাগ নেই, কোনোদিন একটা ঘামাচিও হতে দেখিনি— তবু ব্রণের ওষুধ ও কার কাছ থেকে এবং কোন্ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করে, আমি জানি না। বলেও না কখনো। গায়ত্রী ওর পাতলা স্বচ্ছ হাতখানি আমার মুখে বুলোতে বুলোতে কতদিন বলেছে, ছেলেমানুষ, তুমি এখনও একটা ছেলেমানুষ।