আসলে কারেন্ট খরচা দিন দিন বেড়েই চলেছে তাই এহেন বিধি ব্যবস্থা। এতে কেউ হোঁচট খাক, কী স্বল্প আলোয় চোখে কম দেখুক, সম্পূর্ণার স্বামীর তাতে কোনো মাথা ব্যথা নেই। মোদ্দা কথা, অপচয় বন্ধ হলেই হল।
বিবেক দাস ঘরে কোনো বৈদ্যুতিক পাখাও রাখেনি। ওটা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক। কিন্তু কে বুঝবে সে কথা?
যাই হোক, এরই মধ্যে বাজারের থলি হাতে সম্পূর্ণা শোবার ঘরে গিয়ে আবার উঁকি দিল। একটু ঝঝের সঙ্গেই জিগ্যেস করল কী হল, বাজারে যাবে না।
বিবেক দাস ভুরু কুঁচকে পেছনে তাকিয়ে সম্পূর্ণাকে দেখল।
—অ্যাঁ? কাকে বলছ?
—মানে, ঘরে তো কিছুই নেই। তেল নুন সব কিছু বাড়ন্ত। বিবেক দাস একটা হতাশার ভঙ্গি করে কাঁধ ঝাঁকালো।
—অ্যাঁ? সব কিছুই বাড়ন্ত?
বিবেকদাসকে কিঞ্চিৎ চিন্তিত দেখাল।
—ঠিক আছে, আজতো আবার বর্ষার দিন। তুমি বরং খিচুড়ি বানাও।
প্রথম প্রথম সম্পূর্ণা এইসব কথা অর্থাৎ ওরকম যা হোক করে চালাবার ব্যাপারটা চুপচাপ মেনে নিত। কিন্তু ক্রমেই সব কিছু কেমন অসহ্য হয়ে উঠছিল। এদিকে বিবেক দাসের ব্যবসার অবস্থাও ইদানিং খুব একটা ভাল যাচ্ছিলো না। আর্থিক অবস্থা দিন দিন পড়ে আসছিল। কিন্তু টাকা পয়সার যতই টানাটানি চলুক, সংসার চালাবার ব্যাপারে কোনোরকম মনই নেই।
প্রথম প্রথম সম্পূর্ণা বাপের বাড়িতেই বেশির ভাগ কাটাতো। কিন্তু সে আর কদ্দিন। নিজের ঘর, স্বামীর ঘর, সে স্বাদ তো বাপের বাড়িতে আর পাওয়া যাবে না।
যাইহোক, সব কিছু দেখে শুনে সম্পূর্ণ নিজেই সংসারের হাল ধরল। এদিক সেদিক করে কিছুদিন চালাবার পর যখন দেখল আর কোনো উপায় নেই, তখন নিজের বিয়ের গয়নায় হাত দিল।
প্রতীক বলে একটি ছেলে সম্পূর্ণার কাছে প্রায়ই আসত। প্রতীকদের বাড়িটা ছিল দুতিনটে ঘর পরে। সম্পূর্ণাকে সে বৌদি বলে ডাকত। সম্পূর্ণার তো কোনো নিজের ভাই ছিল না, তাই প্রতীককে সে ভাইয়ের মত দেখত।
প্রতীক ছেলেটি সত্যি ভাল। তার ওপর পরোপকারীও বটে। তা, বিবেক দাস এই ব্যাপারটাকে অর্থাৎ সম্পূর্ণার সঙ্গে ওর মেলামেশাটা ভাল চোখে দেখত না।
সেদিন সন্ধের দিকে প্রতীক এসেছে, ওর হাতে সম্পূর্ণার দেওয়া গয়না। এক ভরি ওজনের সোনার এক জোড়া রিসলেট। এগুলো বিক্রি করে সম্পূর্ণাকে সে বেশ কিছু টাকা পয়সা দেবে বলে উঠোন পেরিয়ে চলে যাচ্ছে, সেই সময় বিবেক দাস প্রথমে প্রতীককে দেখে তারপর সম্পূর্ণাকে দেখে থমকে গেল।
বিবেক দাস কিন্তু এই নিয়ে সেদিন সম্পূর্ণাকে কিছুই বলে নি। তবে ভয়ঙ্কর নাটকীয় ঘটনাটা ঘটে গেলে দিন কয়েক পর।
সেদিন বিজয়া দশমী। শনিবার। অক্টোবরের তের তারিখ।
ঐ দিন সন্ধ্যায় প্রতীক গয়না বিক্রির টাকা দিয়ে চলে যাচ্ছে, সেইসময় বিবেক দাসের সঙ্গে চোখাচোখি দেখা।
প্রতীক চলে যাবার পর বিবেক দাস ঘরে দরজাটাকে বন্ধ করে দিল। একটা মিথ্যে সন্দেহের বশে ওর চোখ দুটো যেন শ্বাপদের মত জ্বলছিল।
সম্পূর্ণাকে সে প্রথমে কিছুই জিগ্যেস করল না। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণায় ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিলো।
একটু পরেই কোমরে হাত রেখে বিবেক দাস গর্জে উঠল। সম্পূর্ণাকে সে সরাসরি জিগ্যেস করল, এই শয়তানি, নষ্ট মেয়েছেলে কোথাকার। তোর তলে তলে এই?’
সম্পূর্ণা ফুঁসে উঠল, ‘কি বলতে চাও তুমি, স্পষ্ট করে বল।‘
—প্রতীক কেন আসে, মনে করিস আমি কিছু বুঝি না?
-ওঃ, আমি কিছু বুঝি না। বউকে খাওয়াতে পার না, সংসারে কোনো দিকে চোখ নেই তার আবার বড় বড় কথা।
বাইরে তখন ঘন ঘন মেঘ গর্জনের সঙ্গে বিদ্যুত চমকাচ্ছিলো। বিবেক দাস নিজেকে সামলাতে পারেনি।
একধাক্কায় সম্পূর্ণাকে মাটিতে ফলে দিয়ে হিংস্র ক্রোধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর সে কী অত্যাচার! এলোপাতাড়ি ঘুষি চালিয়ে চুল ধরে টানতে টানতে সম্পূর্ণার ভারী দেহটাকে রান্না ঘরে ঢুকিয়ে দিল।
সম্পূর্ণার উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা ছিল না। বাধা দেওয়াতো দূরের কথা।
বিবেকদাস রান্নঘরের হুড়কোটাকে বাইরে থেকে টেনে দিল। তারপর আক্রোশে ফুঁসতে ফুসতে ঘর থেকে বাইরে স্টেরয়ে এল।
ওদিকে এরকম একটা মিথ্যে অপবাদের যন্ত্রণা নিয়ে সম্পূর্ণার মাথায় তখন আগুন জ্বলছিলো! হাঁটুতে মুখ গুঁজে দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদল। কাঁদতে কাঁদতে নিজের কপাল চাপড়ালো। একসময় নিজেকে শক্ত করল, উঠে দাঁড়িয়ে পরনের শাড়িটাকে এক হ্যাচকা টানে খুলে নিল। তারপর—
.
বিবেকদাস ফিরে এসেছিল আধঘণ্টা বাদেই।
রান্নাঘরের হুড়কো খুলে ভেতরে ঢুকতে যাবে, একটা অস্ফুট গোঙানির মত শব্দ করে স্পিং-এব মত ছিটকে বেরিয়ে এল।
রান্নাঘরের কড়িকাঠ থেকে সম্পূর্ণার দেহটা ঝুলছে।
হতভম্বের মত বিবেক দাস খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। ধীরে ধীরে সম্বিত ফিরে পেল। ঘটনার আকস্মিকতায় সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। কড়িকাঠ থেকে চোখ ফিরিয়ে মেঝের ওপর বসে পড়ল।
সামান্য একটা ঘটনায় সম্পূর্ণা যে অমন একটা কাণ্ড করবে, ব্যাপারটা যেন তার বিশ্বাসই হচ্ছিলো না।
যাইহোক, একটু পরে নিজেকে সামলে নিল। একটা অজানা আশংকায় বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। ঠাণ্ডা মাথায় বিবেক দাস ভেবে দেখল, সম্পূর্ণার দেহটা এখান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে, তারপর এ বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও গা ঢাকা দিতে হবে।