দোলা বললো, কেন আমিও থেমে যাব। চলার যেমন গতি থাকে ঠিক আমারও বিকল্প আছে।
কিংশুক বললো, তখন তো তুমি আর এই তোমাকে খুঁজে পাবে না।
দ্যাখো কিংশুক তারা এই মিষ্টি কথাগুলো আমাকে বিধলেও আমার গড়ে ওঠাকে আমিই বা কি করে অস্বীকার করবো। আমি জন্মেছি প্রাচুর্যের মধ্যে তাই তোমার এই পরিবেশটাকে আমার অসহ্য লাগে বলেই, তোমাকে আমি সহ্য করতে পারি না।
দ্যাখো দোলা, লোক হাসিয়েতো লাভ নেই। আমরা দুজনেই দুজনের পরিবেশকে আঁকড়ে থেকে শুধুই দাম্পত্য কলহকে বাড়িয়ে তুলবো। তার চেয়ে তুমি তোমার মত থাক আর আমিও চাই থাকতে।
ও—তাহলে তুমি বলতে চাইছ যে-পথ দ্যাখো। কাপুরুষ এবং অমানুষেরা তাই বলে।
স্টপ ইট। তুমিতো গেট টুগেদারে বিশ্বাসী তাই তোমার পথেই তোমাকে যাবার অনুমতি দিলাম। আমি কাপুরুষ বা অমানুষ নই বলেই তোমার নোংরা মানসিকতাকে প্রশ্রয় দিতে পারলাম না।
ভোরের সূর্য ওঠার আগে দোলা গুছিয়ে ফেললো তার জামা কাপড়, ওর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে, ট্যাক্সিতে তুলে দেবার সময় কিংশুক বললো-বেস্ট অফ লাক।
সংঘাত প্রশান্ত – বর্মন রায়
সেটা ছিল উনিশশো সাতানব্বইয়ের অক্টোবরের তের তারিখ। শনিবার চারিদিকে বিসর্জনের করুণ ঢাকের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে প্রতিমা বিসর্জনের পর্ব চলছে। রাত তখন সাড়ে দশটা হবে। ঠিক এই সময় ময়নাগুঁড়ি গ্রামের সরু কাঁচা রাস্তা ধরে একজন মানুষকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল।
লোকটার মাথায় একটা বিরাট চটের বস্তা ছিল। বোঝার চাপে ঘাড়টা যেন ধনুকের মত বেঁকে যাচ্ছিলো।
এতক্ষণ সে কুঁজো হয়ে হাঁটছিলো। হাঁটতে হাঁটতে বোঝর চাপে পা দুটো অসম্ভব টলছিলো। একটু পরেই কাঁচা রাস্তা পার হয়ে একটা কঁকা মাঠ পড়ল। মাঠে মধ্যে বহুদিনের পুরনো একটা পাতকুয়োর কাছে এসে থমকে দাঁড়াল।
আগন্তুকের মুখে একটা ভীত সন্তস্ত্র ভাব; বোঝাটাকে কাঁধ থেকে খুব সন্তর্পণে নামিয়ে নিল।
পকেট থেকে একটা টর্চ বার করে, এক হাতে টর্চ জ্বেলে, বস্তার মুখে বা দড়িটাকে টান মেরে খুলে দিল। এইবার টর্চের জোরালো আলোয় এই শেষবারের মত। নিজের স্ত্রীকে একবার ভালো করে দেখে নিল।
কপালের লাল টকটকে সিঁদুরের টিপটা এখনও জ্বল জ্বল করছে।
ঘণ্টা খানেক আগেই সম্পূর্ণার মৃত্যু হয়েছে। চোখদুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে।
একটু পরেই মৃতদেহটাকে বস্তা বন্দী করল। বস্তা সমেত ডেডবডিটাকে যখন কুয়োর মধ্যে ফেলে দেওয়া হল, ময়নাগুঁড়ি বারোয়ারি পূজোমণ্ডপের বিসর্জন তখন সাঙ্গ হল। ঘন ঘন ঢাক আর কাঁসর ঘন্টার আওয়াজে রাত্রি নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেল।
এবার তার ফিরে যাবার পালা।
লোকটা কুঁয়োতলার ধার ঘেষে অন্ধকারেই দ্রুত পা চালিয়ে তার বাড়িতে গেল। প্রয়োজনীয় টাকা পয়সা আগে থাকতেই সঙ্গে নিয়েছিল। এবারে বাইরে থেকে ঘরের দরজায় তালা দিল। তারপর এদ্দিনের পুরনো তল্লাট ছেড়ে সূচিভেদ্য অন্ধকার ভেদ করে ম্যাজিকের মত কোথায় মিলিয়ে গেল।
.
২.
পরদিন ঠিক সক্কাল বেলায় ময়নাগুঁড়ি গ্রামে একটা ধুন্দুমার কাণ্ড। কুঁয়োর মধ্যে একটা পচা গন্ধকে কেন্দ্র করে গোটা তল্লাটে যেন হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল।
গ্রামেরই এক বয়স্ক ভদ্রলোক সকাল বেলায় পাতকুঁয়োর পাশ দিয়ে পায়চারি করতে করতে হেঁটে আসছিলেন। হঠাৎ একটা বিশ্রি পচা গন্ধ নাকে আসতে থমকে গেলেন। উত্তেজিত হয়ে গ্রামের পাঁচজনকে ডেকে ব্যাপারটা জানাতেই থানায় একটা খবর দেওয়া হল।
মৃতদেহটাকে যখন টেনে তোলা হল, দেখা গেল ওটা একটা আস্ত মৃতদেহ। জলে ভিজে মুখটা যেন বিকৃত হয়ে গেছে। হাত পা গুলো জমে কাঠ হয়ে গেছে।
ময়নাগুঁড়ির প্রত্যেকটা তোক মৃতদেহটাকে চেনে। মেয়েটি বিবেক দাসের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী। বয়স বোধহয় কুড়ি বাইশের বেশি হবে না। প্রাথমিক কাজকর্মের পর ডেড় বডিটাকে পোস্ট মর্টমে পাঠানো হল। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে দেখা গেল, সম্পূর্ণার গলায় ফাঁসের দাগ।
তদন্তের শুরুতেই পুলিশ কিন্তু এ ব্যাপারে বিবেক দাসকেই প্রথমে সন্দেহ করল। বিবেক দাসের সন্ধানে এখানে ওখানে নানা সূত্র ধরে হন্নে হয়ে ঘুরল। কিন্তু কোথায় সে? লোকটা যেন কপূরের মত মিলিয়ে গেছে।
অথচ মাস আষ্টেক আগে কর পরিবারের মেয়ে সম্পূর্ণার বিয়ে হয়েছিলো এক সাধারণ পরিবারে।
পাত্রটি ব্যবসায়ী। নদীয়া জেলার ময়নাগুঁড়ি গ্রামে ওর নিজের বাড়ি। লোকটা একটু অদ্ভুত প্রকৃতির। বদমেজাজি তো ছিলই, তার ওপর হাড় কেপ্পন আর আধ পাগল বলে লোকে ওকে এড়িয়ে চলত। লু যা হোক, বিয়ের পর বেশ চলছিলো ওদের জীবন। হঠাৎ করে ওদের জীবনে নেমে আসে এক গুরুতর সংঘাত।
সেদিন সন্ধেবেলা। বিকেল থেকেই একটানা টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিলো। সন্ধেবেলায় গা ধুয়ে সম্পূর্ণা দেখল, রান্নাঘরে আনাজ-পত্র কিছুই নেই। খানকতক আলু পেঁয়াজ ছাড়া সবজির ঝুড়িটা প্রায় খালি।
এদিকে ঘরে চাল বাড়ন্ত, আটা নেই, তেল নই, নুন নেই। আসলে গত তিনদিন ধরে বাজার সদাই বলতে গেলে কিছুই হয়নি।
সম্পূর্ণা বাজারের কথা জিগ্যেস করতে বিবেক দাস গম্ভীর হয়ে গেল।
একটা নড়বড়ে চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে বিবেক দাস সেইসময় বসবার ঘরের ডুম বদলাচ্ছিলো।
ইতিপূর্বে শোবার ঘরে চল্লিশ পাওয়ারের বাল ছিল। কিন্তু কিছুদিন ধরে পঁচিশ পাওয়ারের বাল লাগানোর কথাটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলো।