ঘরের ভেতর কিছুক্ষণের জন্যে নীরবতা নামে। পাশের ঘরে আধশোয়া হয়ে বটা দরজার ফাঁক দিয়ে বেডরুমে উঁকি মারে, এদের দাম্পত্য কলহ তাহলে এখনকার মত ঠাণ্ডা হয়েছে। অভিজ্ঞ বটা জানে, কিভাবে হাওয়া বদলে পরিবেশ নিজের পক্ষে আনা যায়। সঠিক পরিবেশ না এলে, তাদের কাজ করতে অসুবিধা হয়।
“তোমার হয়ে গেছে, প্রতিভা! স্বপন জিজ্ঞেস করে। লক্ষ্মীটি আর এক মিনিট অপেক্ষা কর।” আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখের পাতার ওপরে মাস্কারা লাগাতে লাগাতে প্রতিভা বলে, আধুনিক প্রসাধনে কিভাবে নিজেকে আরও আকর্ষণীয় করা যায়; বিউটি পার্লারে গিয়ে সেই আর্ট প্রতিভা শিখে এসেছে।
ঠিক এসময় আবার ঘরের কোণ থেকে ম্যাও শব্দ ভেসে আসে, ম্যাও শব্দ শুনে স্বপন চমকে ওঠে। উঁকি মেরে দ্যাখে—আরে এ যে সত্যিকারের বেড়াল। “আবার সেই হাড় হাভাতে বেড়ালটা ঘরের মধ্যে ঢুকেছে?” কুদ্ধকণ্ঠে কথাগুলো বলে, পায়ের চটি খুলে স্বপন-বেড়ালটাকে তাক করে ছুঁড়ে মারে। আত্মরক্ষার জন্যে কুঁই ও শব্দ করে ভয়ার্ত বেড়াল খাটের নীচে সেঁধোতে যায় খাটের এক ধারে। ধুনুচিতে রাখা ধুনো জ্বলছিল, বেড়ালের ধাক্কায় ধুনুচি উল্টে যায়। জ্বলন্ত ছোবড়ার টুকরোগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে। একটা টুকরো ঝুলে থাকা বেড কভারে ছিটকে গিয়ে লাগে। পরক্ষণেই বেডকভারটা দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে।
গরমের দিন হওয়ায়, শুধু চারতলার ছাদ নয়, ঘরটাও গরম হয়েছিল, ফ্যানের হাওয়ার লেলিহান আগুনের শিখা ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয় না। আগুন! আগুন! বাঁচাও! বাঁচাও! বলে প্রতিভা আর স্বপন দুজনেই আর্তচিৎকার করে ওঠে, দরজা দিয়ে পালানোর পথ ছিল না। সেখানে আগুন জ্বলছল, পাশের ঘরে উঠে বসা বটাও ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল হয়ে গেছিল। চুরি করতে এসে একি বিপদ! বাথরুমের গরাদবিহীন জানলা দিয়ে, সরীসৃপের মত রেনওয়াটার পাইপ বেয়ে নীচের মাটিতে পা রাখা তার কছে কোন ব্যাপার নয় কিন্তু এই নবদম্পতির কি হাল হবে? বটা দ্রুত চিন্তা করতে থাকে।
ওদিকে চারতলার ছাদে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খেতে খেতে পুলকেশ সবকিছু লক্ষ করছিলেন। আগুন দেখে পুলকেশও কম বিচলিত হন নি। আগুন দেখে মোবাইল ফোনে ভাষ্যকারের মত তিনি, ধারাবিবরণী দিয়ে যাচ্ছিলেন। বাড়ির নীচে লোক জড় হয়ে গেছিল। জনতার ভয়ার্ত চিৎকার শিশুর ক্রন্দন সব কিছু মিলে এক বিশৃঙ্খল ভয়াবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল।
দরজা বন্ধ থাকায় দমকলের লোকেরা এসে ধাক্কা দিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করছিলেন। হঠাৎ সবাইকে তাক করে কম্বল মুড়ি দিয়ে রটা ঘরের মধ্যে ঢুকে যায়। তারপর আগুনের শিখা উপেক্ষা করে, প্রথমে প্রতিভা, পরে স্বপনকে কম্বলে জড়িয়ে দরজা খুলে বাইরে বের করে নিয়ে আসে, চারতলার ছাদে দাঁড়িয়ে পুলিশ অফিসার পুলকেশ সরকার সবকিছু লক্ষ্য করে, রীতিমত বেকুব বনে যান। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালান, দাগী আসামী বটুক সাপুইয়ের ভিন্নতর চেহারা পুলকেশের মগজে ঝড় তোলে।
দমকল ও সহৃদয় লোকেদের চেষ্টায় ও যত্নে নীচে নামিয়ে প্রতিভাও স্বপনকে সুস্থ করে তোলা হয়। তাদের আঘাত সে রকম গুরুতর ছিল না। বটুক সাপুই কি ভাবে তাদের ঘরে এল, তার হদিশ স্বামী-স্ত্রী করতে পারছিল না। তবে বটা না। থাকলে, তারা যে নির্ঘাৎ পুড়ে মারা যেত সে ব্যাপারে তাদের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না।
পুলিশের লোকেরা এসে, অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে বটুক সাঁপুইকে কাছের নার্সিংহোমে নিয়ে যায়। তার দেহের অনেক জায়গায় পুড়ে গেছিল। তাহলেও ডাক্তার। আশ্বাস দিয়ে জানালেন, গায়ে মুখে পোড়া দাগ নিয়ে লোকটি এ যাত্রায় বেঁচে যাবে। কেবিনে ঢুকে বটার বিছানার পাশে একান্তে পুলকেশ জিজ্ঞেস করলেন,—”বটা …তুমি আগুন দেখে পালিয়ে গেলে না কেন? নিজের জীবন বিপন্ন করে, ঘরে ঢুকে তুমি ওদের বাঁচাতে গেলে কেন?”
ক্লান্ত দৃষ্টিতে পুলকেশের দিকে বটা উত্তর দেয়। “সরকার সাহেব আপনি এত কথা জানলেন কি করে?”
“–দ্যাখ বটা…তোমাকে ধরতে আজ দলবল নিয়ে আমি জাল বিছিয়ে ছিলাম। পেছনের বাড়ির চারতলার ছাদে দাঁড়িয়ে, আমি তোমার গতিবিধির ওপর নজর রাখছিলাম, অবাক হয়ে আমি দেখলাম, আগুন লেগেছে দেখে ভয় পেয়ে তুমি পালিয়ে গেলে না। নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে, সুখি গৃহকোণে বাসা বাধা দম্পতিকে বাঁচাবার জন্যে, তুমি অসাধ্য সাধন করলে। বটা তুমি এত মহৎ! না না …পুলিশ তোমায় গ্রেপ্তারের কথা ভাবছে না। বরঞ্চ তুমি যাতে সরকারি পুরস্কার পাও আমরা সে চেষ্টা করব।”
শ্বশুরবাড়ি নয়— ক্লাব হাউস – বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
কি হল দোলা, এই-রে, এতদিনের জিনিসটাকে তুমি ভেঙ্গে ফেললে।
ভাঙ্গিনি, ফেলে দিয়েছি।
ফেলে দিয়েছ?
হ্যাঁ–রং চটা ভাঙ্গা একটা ফুলদানি, এটা আবার কেউ রাখে নাকি।
কি বলছো কি, জানো-ওটা আমার ঠাকুরদার আমলের ফুলদানি, এই ধরনের ফুলদানি আর পাবে।
দ্যাখো কিংশুক, সেই পৃথিবীটা আজ বদলে গেছে। কম্পুউটার আর ইন্টারনেটের যুগে, এর কোন মূল্য নেই। তাই এই ধরনের কিছু দেখলেই আমি ফেলে দেবো।
অফিস যাবার সময় তোমার সঙ্গে তর্ক করবোনা, এর উত্তর ফিরে এসে দেবো। একটু তাড়া আছে, ব্রেকফাস্টটা নিয়ে এস।