অনার্সের একমাত্র ছাত্রী। ছোট ইউনিভার্সিটিতে তখন ওরকম হতো। ফিলসফিতে একজন, সংস্কৃতে একজন, অর্থনীতিতে দুজন—এই রকম অল্প ছাত্র-ছাত্রী পড়ত।
তবে নম্রতার এ রকম নারীমূর্তি আগে কখনও দেখি নি বা ভাবিনি সে আমার অজ্ঞতার জন্যই। আর জ্ঞান বৃক্ষের ফল খাওয়ার পর থেকেই তো ইভের অজ্ঞতা মোচন হয়েছিল। সবকিছু জেনে ফেলেছিল ইভ। কিন্তু একই সঙ্গে অ্যাডামও তো খেয়েছিল…মনের মধ্যে কে যেন প্রতিবাদ করে উঠল…।
কাট্।
অফ ভয়েসে ভেসে আসে সেই কবিতার লাইনগুলি। এবার নারী কণ্ঠে।
সেদিনও এমনই ফসলবিলাসী হাওয়া…
তারপর শুরু হয় সমুদ্রের তীরে আছড়ে পড়ার দানবীয় দৃশ্য, তাণ্ডব ও উন্মত্ততা। কিছুক্ষণ চলতে থাকবে এই জীবন্ত প্রাকৃতিক উচ্ছ্বাস। আর মাঝেমাঝেই সারা ছবিটি জুড়ে আরব সাগরের উথাল-পাথাল ঢেউ দেখা যাবে নানা রকম ফেরে। প্রয়োজনে ‘ওথেলো’ সিনেমাটির সমুদ্রের দৃশ্যকে দেখান যেতে পারে।
ফিল্মটিতে মাঝেমাঝেই এত সমুদ্র কেন? সমালোচকরা কি বলবেন জানি না তবে আদিগন্ত দুরন্ত সমুদ্রের বিস্তার ও তার বুকের ওপর বিশাল স্ফীত আকাশের দৃশ্য প্রতিস্থাপিত করে সংযোগ রক্ষা করা ছাড়া অন্য কোনও চলচ্চিত্রের ইমেজ—আমাদের এই জীবনের টুকরো ইমেজকেও বোঝানোর মতো শক্তিশালী উপাদান আমার আর মনে আসছে না। তাই আমার চিত্রনাট্য জুড়ে শুধু সমুদ্রের দৃশ্য আর জলের প্রচণ্ড শব্দ। সে শব্দে চাপা পড়ে যাচ্ছে নম্রতার সেই সব দিনের তীব্র চিৎকার—আর মানবজাতির হাহাকার, ব্যথা আর প্রতিবাদ যা ঘুরে ফিরে আসছে আমাদের জীবনে। তাই শুধু সমুদ্রের দৃশ্য চিত্রনাট্য ভরে বারবার এসছে। যেন ভাসিয়ে দেবার ভয় দেখাচ্ছে সবকিছুকে, সবাইকে।
স্বামীর হাতে মার খাওয়ার সময় নম্রতা যে তাণ্ডব ও ক্ষোভ অনুভব করত সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে তার বোধ হয় কিছু মিল আছে। নম্রতার শিরায় শিরায় প্রবাহিত রক্তের সেই অনুভূতি–সব মিলিয়ে জীবনের অদ্ভুত স্পন্দন যাতে আপনাদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে তাই এই চিত্রনাট্য বা চলচ্চিত্র ভরে শুধু সমুদ্রের দৃশ্য রাখা হয়েছে।
কোথা থেকে যেন একটা সিম্ফনির সুর শোনা যাচ্ছে। বিটোফেনের সেভেনথ সিম্ফনি? থার্ড মুভমেন্ট— মার্চ অফ দি ওশেন? সেই কুড়ি বছর আগের মতো আবার। সমুদ্র নাবিকদের তরঙ্গচ্ছ্বাসে ওতপ্রোত হয়ে জড়িয়ে পড়া।
চিত্রনাট্যটির একেবারে শেষে তাই লিখলাম—
বিটোফেনের সেভেন সিম্ফনির সুর যেন শাশ্বত সময়ের গভীরে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বাজতে লাগল। কোনওদিন চলচ্চিত্রে রূপায়িত না হওয়া শুধু সমুদ্রের এই চিত্রনাট্যে এই আবহসঙ্গীত বাজতে থাকল চিরকালের মতো। ইংরেজ রোম্যানটিক কবি কিটসের লেখা কবিতা ‘ওড অন ও গ্রিসিয়ান আর্ন’-এ যেমন বলা হয়েছে ঐতিহাসিক মৃৎপাত্রটির গায়ে খোদাই করা রাখাল বালকের বাঁশী যেন চিরকাল ধরে বেজেই চলেছে। কোনদিন থামবে না তার সুর। আর চুম্বনরত প্রেমিক
প্রেমিকারাও যেন চিরকালের। শাশ্বত হয়ে আছে সেই কবেকার সুর এবং ভালোবাসা। হার্ড মেলডিজ আর সুইট বাট দোজ অফ আনহার্ড আর সুইটার।
আসলে কোথাও বিটোফেনের সুর বাজছে না, সমুদ্র নেই, নম্রতা নেই, তরুণ। নেই। দীর্ঘ নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে কাটাতে বহুদিন পরে ছাত্র জীবনের সেই রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের লনে এসে দাঁড়াতেই এসব মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন শব্দ সুর সব শোনা যাচ্ছে। বিশাল ঢেউ নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে সমুদ্রকে। আসলে সেদিনের সেই তরুণ ও নম্রতার মতো আজকের দিনের ইউনিভার্সিটির দুটি ছেলেমেয়েকে দেখা যাচ্ছে দূর থেকে মাঠের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে আসতে। আমার। সমুদ্র তাদের ওপর ভয়ঙ্কর ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
কেন জানি না মুহূর্তে থেমে গেল বিটোফেনের সিম্ফনির সুর।
নাঃ মুহূর্ক্সে জন্য বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল। ওই তো সিডি প্লেয়ারে আবার বাজছে বিটোফেনের মূচ্ছনা। এবার নাইনথ সিম্ফনি। ১৯৮৯-এ বার্লিন ওয়াল ভেঙে ফেলার পর পাঁচলক্ষ বার্লিনবাপ্রি খুশিতে উত্তাল তরঙ্গের উচ্ছ্বাসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যে এটি বাজান হয়েছিল। তখন অর্কেস্ট্রা বাজিয়ে ছিলেন লিওনার্ড বার্নস্টাইন। হঠাৎ জলের নয় মনের চোখে দেখতে লাগলাম জনসমুদ্র। প্রবল ও স্বতঃস্ফূর্ত রঙ্গের উচ্ছ্বাস।
শেষের সে বিচার – ডাঃ অরুণকুমার দত্ত
পুলকেশ পেছনের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। ঠিক সামনের সমারাল বাড়ির চারতলার এক ফ্ল্যাটের গরাদবিহীন বাথরুমের জানলার ভেতর দিয়ে-সরীসৃপের মত একটা কালো লোক ঢুকে গেল। চারদিকে তখন রাত্রে অন্ধকার নামছে। পুলকেশ কলকাতা পুলিশের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের একজন উচ্চপদস্থ অফিসার, বেহালার এই অঞ্চলের নাম যদু কলোনী। চারপাশে এলোমেলো বহুতল অট্টালিকাগুলো দ্রুত গজিয়ে উঠছে। যার ফলে, বেহালার লোকসংখ্যাই খালি বেড়ে যায় নি; স্থানীয় জিওগ্রাফিও বদলে গেছে।
রাত বেশি না হলেও, সামনের চারতলা বাড়ির ফ্ল্যাটগুলোর বেশিরভাগ বাসিন্দারাই অনুপস্থিত ছিল। কিছু দূরে নাম করা আর্টিষ্টদের নিয়ে এক জলসা চলছিল। সেই জলসার আকর্ষণ, স্থানীয় বাসিন্দাদের সেখানে আটকে রেখেছিল। সামনের ফ্ল্যাটের চারতলার শোবার ঘরে নীল আলো জ্বলছিল। সেই লোকটাকে সে ঘরে ঢুকতে দেখে পুলকেশ, পকেট থেকে বাইনাকুলার বার করে চোখ রাখলেন।