আজ থেকে কুড়ি বছর আগে যখন নম্রতার সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল তখন এ সব ঘটনা ছিল না বা আমাদের জানা ছিল না। সরলতা ঝরে পড়েছিল রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের লনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসে, আর নম্রতার চাপা হাহাকারে এবং আমার অবাক হয়ে যাওয়ার পরম্পরায় বা সিকোয়েন্সে। সেই সিকোয়েন্সগুলিকে নিয়ে এখনকার সামাজিক-মানসিক পরিপ্রেক্ষিতে সাজিয়ে নিচ্ছি এই চিত্রনাট্য।
মনের মধ্যে পড়ে থাকা নম্রতার ঘোরা বন্ধ হয়ে যাওয়া পৃথিবীটাকে টোকা দিয়ে ঘুরিয়ে দিলাম। ওর পৃথিবীটা ঘুরতে লাগল গ্লোরে মতো। যেন সেটি সৌরজগরে কোন নিয়মই মানে না। তবে কি আমার আঙুলেই তার ঘোরা ফেরা। পুরুষের আঙুলের ছোঁয়ায় বা নির্দেশে বা ইচ্ছেয় নারী-জগৎ আজও ঘুরে চলেছে। সর্বনাশ! সমালোচকরা ফিল্মটির এ রকম মানে করলেই তো গেল। যা নারীবাদী হাওয়া চারপাশে! এখনও কি পুরুষের অঙ্গুলি হেলনে নারীর জীবন ওঠা নামা করে। এখন তো ভারতীয় আইনের ৪৯৮ (ক) ধারা আছে। যেখানে বধূ তার স্বামী ও তার পরিবারের প্রতি অভিযোগ আনতে পারে শারীরিক বা মানসিক অত্যাচারের। গ্রেপ্তার হয়ে যাবে সকলে। জামিন পাওয়া যাবে না। বিচার হবে পরে। ততদিনে সমস্ত সামাজিক মান-সম্মান চুরমার।
যাই হোক সেদিন পর্যন্ত নম্রতার এ সব কিছু ছিল না। সেদিন ও সাদা শাড়ি আর থ্রি-কোয়ার্টার ব্লাউজ পরে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের লনে বসেছিল। যা বলছিল তাই নিয়েই এই চিত্রনাট্য লিখছি। চিত্রনাট্যের শুরুটা হচ্ছে এইরকম—
বরানগরে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের লনের মরকত কুঞ্জের সবুজ লন। একটু ফাঁকা ফাঁকা। আশির দশকে যেমন ছিল। সেখানে বসে আছে একুশ বছরের এক যুবক ও বাইশ বছরের এক যুবতী। ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রী। ছাত্রীটি সুন্দরী, তন্বী। একটু একটু হাওয়া দিচ্ছে। তার শাদা শাড়ির আঁচল একটু উড়ছে। ছেলেটি উদাস, ভাবুক, সম্ভবত গ্রামের ছেলে শহরে পড়তে এসেছে। কবি কবি ভাব।
তরুণ।। আচ্ছা তুই সব সময় শাদা শাড়ি পরিস কেন?
নম্রতা।। আমি রঙিন শাড়িও পরি। তবে ইউনিভার্সিটিতে কেবল সাদা পরি। কারণ বাবা মনে করেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রঙিন পোশাক না পরে যাওয়াই ভালো।
নম্রতার শাদা পোশাক সহ শরীরের ওপর ক্যামেরা প্যান করে এসে মুখের বিগ ক্লোজ আপে পরিণত হয়। পর্দা জুড়ে নম্রতার মুখ ফুটে ওঠে। আস্তে আস্তে জুম ইন করতে থাকে ক্যামেরা। নম্রতা ও তার পাশের ছেলেটি। এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের লনের আশপাশ ও অন্যান্য পরিকাঠামো ফুটে উঠাতে থাকে ফ্রেমের মধ্যে। ছোট ছোট হয়ে যাচ্ছে সব কিছু। অফ ভয়েসে শোনা যাচ্ছে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের শাশ্বতী কবিতার অংশ।
সেদিনও এমনই ফসলবিলাসী হাওয়া…।
কবিতার সঙ্গে সঙ্গে আবার জুম আউট হতে থাকে ও শেষ পর্যন্ত নম্রতার মুখ পর্দা জুড়ে ফুটে ওঠে।
মিড শট।
নম্রতা।। আমাকে যখন মারতো তখন আমি ইচ্ছে করে জোরে জোরে চীৎকার করতাম যাতে আশপাশের বাড়ির সকলে শুনতে পায়।
ক্লোজ শট। তরুরে মুখ। বিস্ময়ে হতবাক ও সহানুভূতিতে থরো থরো।
কাট্।
মিড শট।
নম্রতা ও তরুণ লনে বসে আছে।
নম্রতা।। যাই বল ছেলেরা মেয়েদের সেক্স ছাড়া আর কোনও ভাবে ভাবতে পারে না।
তরুণ।। এটা তুই ঠিক বললি না।
নম্রতা।। না, এটা আমি ঠিকই বলছি। (হাসতে হাসতে)
তরুণ।। (হাসতে হাসতে) তা হলে তুই মনে রাখিস এই সঙ্গে তুই তোর বাবাকে, দাদাকে এবং তোর সমস্ত পুরুষ আত্মীয়দেরও রাখছি।
হেসে ফেলে নম্রতা।
ফ্রাঁসোয়া ভুফোর ‘জুল এ জিম’ ছবির একটা ক্লিপিংস দেখানো হচ্ছে। সাদা কালো আগেকার ছবি। সম্ভবত জিম একটি পার্টিতে গেছে। সেখানে আর এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে তার দেখা হল। সঙ্গে এক অপরূপ সুন্দরী যুবতী। কিন্তু সে মূক ও বধির। জিম অবাক হলে তাকে সে এই বিয়ে করার কারণ বুঝিয়ে বলে, ওনলি ফর সেক্স।–
ইংরেজি সাবটাইটেলে এই কথাটিই ফুটে ওঠে।
কাট্।
কলকাতার কফি হাউসের একটি দৃশ্য। তিনজন যুবক গল্প করছে। তাদের মধ্যে তরুণও আছে।
এক বন্ধু।। বিয়ে ব্যাপারটা সেক্সেরই ব্যাপার।
আর এক বন্ধ… ভুল ধারণা। তুমি সেক্স নিয়ে দিনে কত ঘন্টা চিন্তা করবে, চারঘন্টা? বাকি কুড়ি ঘন্টা তুমি কি নিয়ে ভাববে? বিয়ে ব্যাপারটা অত্যন্ত মাঙ্গলিক।
কাট্।
কাট অবাক হয়ে দেখলাম নম্রতা কি পোশাক পরেছে আজ। সাদা রঙেরই শাড়ি ব্লাউজ যেমন পরে তেমনই, কিন্তু… কেমন যেন একটু বেশি স্বচ্ছ তার ব্লাউজ। কিন্তু এ রকম কেন? বাবার ইচ্ছেয় সাদা পোশাক পরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসা। কিন্তু আদর্শের সেই কারণকে ছাড়িয়ে একটু বেশি গভীরে যেতে চাইছে তার পোশাক।
জিগেস করলাম, কি রে।
এই পরীক্ষার জন্য স্যারের কাছে কিছু ইমপর্টেন্ট কোনে জানতে এলাম।
ধ্বক করে উঠল বুকের মধ্যে। বয়স্ক অধ্যাপক, ফিলসফির হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট। গয়ের রঙ কালো, সুপুরুষ চেহারা নয়। আর নম্রতা—ঠিক তার বিপরীত। যেন বিউটি অ্যান্ড দি…না থাক অতদূর যাব না। ওই অধ্যাপকের কথা ভেবে আতঙ্কিত হলাম। তার মনের মধ্যে কি রকম হবে? তিনি কতদূর গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বলে দেবেন? তার ওপর তিনিও নিশ্চয়ই শুনেছেন নম্রতার বিবাহিত জীবনে হেনস্থা হওয়ার কথা। কামনা, সহানুভূতি কতদুর সমান্তরাল ভাবে যাবে না হঠাৎ মিলে যাবে কে জানে? ঘটনাক্রমে নম্রতাও সেই বছরে রবীন্দ্রভারতীতে ফিলসফি