ঘরে ফিরে স্নান খোওয়া সেরে চলে গেলাম হসপিটালে। নতুন একজন পেশেন্ট ভর্তি হয়েছে এই মাত্র। বাড়িতে ডেলিভারি হতে গিয়ে বিপর্যয় ঘটিয়ে বসেছে। নার্স আয়া সবাইকে নিয়ে ঢুকে পড়লাম লেবার রুমে। ভুলে গেলাম হেনা আলমের কথা! অনেক পরিশ্রমের পর যথাযথ নিয়মে ভগবানের ইচ্ছায় ডেলিভারিটা করাতে পারলাম। প্রসূতির অবস্থা ভালো নয়। তবে বাচ্চাটা ভালো আছে। লাল রক্তের ড্যালা। যেন একটা। কি সুন্দর কচি মুখ। হাত পা নেড়ে চিউ চিউ করছে দুষ্টুটা। এই রকম একটি শিশুকে কখনো মাতৃগর্ভ থেকে বার করে এনে গলা টিপে মারা যায়?
আবার মনে পড়ল হেনা আলমের কথা। সারাদিনে বার বার চেষ্টা করেও হেনা আলমকে ভুলতে পারলাম না। হেনা আলমের প্রেমিক কে তা জানি না। তবে এটুকু জানি এই শহরের উপকেণ্ঠ পাহাড়ের গায়ে যে মার্বেল প্যালেসটা, সেটা হেনা আলমের! এখানকার দুদুটো সিনেমা হলের মালিক হেনা আলম। এ ছাড়াও একটি বস্তি, ধান কল ও অয়েল মিলের মালিক হেনা আলমরা। হেনা আলম মমতাজ সুন্দরী। মুঘল হারেমের রূপসীদের কথা যেন মনে করিয়ে দেয় হেনা আলম। কিন্তু কেন তার এই পদস্খলন? হেনা আলমের স্বামীকে আমি দেখিনি। হেনা আলমের মতো সুন্দরীকে যিনি রাজার ঐশ্বর্য দিতে পেরেছেন তিনি যেমন তেমন লোক নন। অথচ সেই মানুষকে ফাঁকি দিয়ে ঐ প্রাসাদের অভ্যন্তরে কি করে পর পুরুষের সন্তান গর্ভে ধারণ করেন উনি তা আমার বোধগম্য হল না।
সে রাতেও অনেকক্ষণ ধরে হেনা আলমের মুখ মনে করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত তখন বারোটা। শীতের রাত। প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহে সারা শহর, পাহাড় পাহাড়তলি কনকন করছে! গাছ থেকে পশুপক্ষি মরে পড়ে যাচ্ছে। জঙ্গল থেকে বড় বড় গাষ্ট্রে শুকনো গুঁড়ি এনে গাছতলায় ধুনি জ্বালানো হয়েছে! যাতে অধিক সংখ্যক পশুপক্ষী মরে না যায়।
ডোরবেলটা বেজে উঠল।
আঃ। সেরেছে। এই রাতে আবার কোথায় যেতে হয় কে জানে?
উঠে গিয়ে আলো জ্বেলেই সাড়া দিলাম—কে?
—আমি।
পরিচিত কণ্ঠস্বর। বুকটা যেন কেঁপে উঠল। লু জিজ্ঞেস করলাম কে আপনি?
–এরই মধ্যে ভুলে গেলেন।
হেনা আলম। হেনা আলম ছাড়া আর কেউ নয়। অপ্রত্যাশিত কিন্তু প্রত্যাশিত। সেই একই আবদার করবেন হয়তো। করুন। বু তো কিছুক্ষণের জন্যও দেখতে পাবো সেই চৌধবি কা চাঁদকে। দরজাটা খুলে দিলাম।
আজ আর কালো বোরখা নয়। কাশ্মিরী সিল্কের ওপর নানা রকম কাজ করা বোরখা। সেই সঙ্গে এক মধুর সৌরভে গোটা ঘর ভরে গেল। এ সৌরভ কাল ছিল না।
দরজাটা খোলা ছিল। হেনাই বন্ধ করলেন। আজ আর বলতে হ’ল না। মুখের ঢাকা নিজেই প্রালেন। তারপর একটা কৌচের ওপর বসে যেন ওনার নিজেরই বাড়ি এমনভাবে বললেন—কি হ’ল বসুন।
আমি গত রাতের মতোই সারা গায়ে শাল জড়িয়ে নার মুখোমুখি বসলাম। হেনা বললেন আমি চলে যাবার পর কাল রাতে নিশ্চয়ই আপনি ভালো করে ঘুমোতে পারেন নি?
–না পারিনি।
—আসলে আমার এই দেহতে এত রূপ কিভাবে যে তৈরি হয়েছিল তা নিজেই আমি ভাবতে পারি না। আয়নায় যখন নিজেকে দেখি তখন মনে মনে হিন্দুদের মতো পঞ্চপ্রদীপ জ্বেলে নিজেকে আরতি করি। তাই মরতে আমার ইচ্ছে করে না ডাক্তার। এর পরে আবার যদি কখনো রদেহ নিয়ে পৃথিবীতে আসি তখনো কি এই রূপ আমি পাবো?
আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে চোখের পাতা না ফেলে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
হেনা আলম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–কি ঠিক করলেন ঐ ব্যাপারে?
আমি যেন কিছুই জানি না এমনভাবে বললাম–কোন ব্যাপারে?
—সেকি! কাল যে ব্যাপারে কথা বললাম। মানে যে ভাবেই হোক ওটা করাতেই হবে।
আমার রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠল। এই হেনা আলমের গর্ভে যে শিশু আছে সেটা ছেলে কি মেয়ে জানি না। মেয়ে হলে সে হয়তো হেনা আলমের চেয়েও সুন্দরী। হবে। ছেলে হলে হবে নবাবজাদা। তার আবির্ভাবকে আমি কোন অধিকারে বাধা দেবো? তোক সে অবাঞ্ছিত। বু সে শূন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ। তাকে আসতে দিতেই হবে। আমি বললাম–এ কাজ যে কখনো করিনি মিসেস আলম।
–জানি। কিন্তু আমার জন্য এটুকু আপনাকে করতেই হবে। যে ভুল আমি একবার করেছি জীবনে সে ভুল দ্বিতীয়বার করব না। আপনাকে আমি কথা দিলাম ডাক্তার।
–মিসেস আলম। আজ যাকে আপনি অবাঞ্ছিত মনে করছেন একদিন তো তাকেই চেয়েছিলেন একান্তভাবে? ওর পিতা আপনার ঘৃণ্য হতে পারেন কিন্তু ঐ শিশুটা আপনার কাছে কোন অপরাধটা করল শুনি? ও তো ওর পরম নির্ভরযোগ্য স্থান ভেবেই আপনার জঠরে নিশ্চিন্তে নিজের বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে।
হেনা আলম দুহাতে আমার দুটি হাত আবার জড়িয়ে ধরলেন। আবার সেই উষ্ণ প্রশ। এবার নিজেই আমার কোলের ওপর নুয়ে পড়ে বললেন–সেন্টিমেন্টাল হবেন না ডাক্তার, প্লিজ। আপনি যা বলছেন আমি ব বুঝতে পারছি। কিন্তু লুও আমি এ কাজ করতে চাইছি কেন জানেন? এর পিতা অর্থাৎ যাকে ভালোবেসে আমার সর্বস্ব দিয়েছিলাম সে আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। সে আর কখনো আমার কাছে ফিরে আসবে না। আমার স্বামী মেহবুব আলম এই অঞ্চলে সব চেয়ে ধনী এবং মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি। বছর দুই আগে একটি সাংঘাতিক বিস্ফোরণে তার দুটি চোখ নষ্ট হয়ে যায় একটা পাও বাদ দিতে হয় কেটে। ক্রাচে ভর দিয়ে তিনি এক পায়ে চলেন। তার বীভৎস মুখের দিকে তাকালে ভয়ে বুক শুকিয়ে যায়। এর ফলে স্বামীর সঙ্গে সহবাসে আমার রুচি হয় না। উনি বিচক্ষণ লোক। নিজেও সেটা বোঝেন। তাই আমাকে বিরক্ত করেন না। এই সময় আমাদের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়র একটি ছেলেকে ভালো লাগে আমার। সে আমাকে কথা দেয় আমায় নিয়ে সে দূরে বহুদূরে চলে যাবে। যেখানে মেহবুব সাহেবও আমাদের নাগাল পাবেন না। আমি তাকে বিশ্বাস করি। এবং তার সঙ্গে গোপনে মিলিত হই। অবশ্যই সেটা সন্তান উৎপাদনের জন্য নয়। দেহসুখের লালসায়। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য যে সে আমাকে ছেড়ে গেছে। এখন এই সন্তানের আমি কি পরিচয় দেবো? কোথায় রাখব একে? একা যে কোথাও চলে যাবে এখান থেকে, যাবই বা কোথায়? এই রূপই যে আমার শত্রু হবে। তাছাড়া মেহবুব সাহেবের ঐ বিশাল ঐশ্বর্যও তো ভোগ করতে পারব না আর।