—হ্যাঁ। সে ভারি লজ্জার কথা।
আমি বললাম—শুনুন। রাত দুপুরে আমি কোন অচেনা মহিলার লজ্জার কথা শুনতে রাজি নই। সবে ডাক্তারি পাশ করে মফঃস্বল শহরের এই হাসপাতালে চাকরিটা জুটিয়েছি। এটাকে আমি খোয়াতে চাই না। আপনি কে, কেন এবং কোথা থেকে এসেছেন কিছুই বুঝতে পারছি না। এই অবস্থায় কোন জরুরি কল নিয়ে হঠাৎ কেউ এসে পড়লে আমার ঘরে আপনাকে দেখবে। তাতে আমার বদনাম হবে।
—আয়্যাম স্যরি ডক্টর। আমার বক্তব্য আমি এখুনি পেশ করছি।
–তার আগে আপনার মুখের, ঢাকাটা সরাতে হবে। আপনার মুখ না দেখলে আমি কথা বলব না।
বাঃ! বেশ বললেন তো? রাতদুপুরে আপনি পরস্ত্রীর মুখ দেখবেন? ছিঃ ছিঃ। আপনার মতো লোকের এ মানায় না।
—আপনি তাহলে যেতে পারেন।
বলার সঙ্গে সঙ্গেই নেকাবটা সরে গেল। আর এক পরমাসুন্দরীর মুখ প্রকাশিত হল সেই কালো নেকাবের আড়ালে। ঈশ্বর তার তুলির টানে এমন একটি মুখ এঁকেছেন যে সে মুখের তুলনা নেই। শুধু নেকাব নয়, বোরখার আড়াল থেকেও সেই মুর্তে রাজহংসীর মতো যে শরীরটা বেরিয়ে এলো তা দেখে অস্থির না হয়ে থাকতে পারে না কেউ। আমি চোখের পাতা ফেলতেও ভুলে গেলাম। বেশ কিছুদিন আগে এই এলাকায় একবার এই বিদ্যুত্বর্ণাকে দূর থেকে দেখেছিলাম। তখন বোরখা ছিল না। দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। মনে আছে চোখে চোখ পড়তেই চোখের ভাষায় মৃদু ধমক দিয়ে বিদ্যুতের মতো সরে গিয়েছিলেন উনি। আর আজ এই গভীর রাতে যৌবনের পশরায় রূপের প্রদীপ জ্বেলে সেই তিনি যে এমনভাবে আমার ঘরে এসে হাজির হবেন তা কি ভাবতে পেরেছিলাম?
এবার আমারই গলা কাঁপার পালা—আ-আ-আপনি।
-হ্যাঁ আমি। মিসেস হেনা আলম।
—আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
—কি করে বুঝবেন? আমার এই রূপ যে বিধ্বংসী অগ্নিশিখা। তাই তো একে বোরখা দিয়ে ঢেকেছিলাম। দেখতে চাইলেন বলেই দেখালাম। যাক, যে কথা বলতে এসছিলাম। আপনাকে আমার একটা উপকার করতে হবে।
—আই মাস্ট ডু ফর ইউ।
—আমি সাত মাসের প্রেগন্যান্ট। আমার এটাকে অ্যাবরশান করাতে হবে।
আমি শিউরে উঠলাম—মিসেস আলম। একি বলছেন আপনি?
—যা বলছি ঠিকই বলছি ডাক্তার।
—আমি জানি আপনি অত্যন্ত অভিজাত পরিবারের বউ। আপনার স্বামী বর্তমান। এ ক্ষেত্রে এই ব্যাপারে তাঁরই আসা উচিত ছিল। তার বদলে এই গভীর রাতে আপনি।
—আসতে বাধ্য হয়েছি। কেননা অ্যাবরশানের ব্যাপারটা অত্যন্ত গোপনীয়। আমার স্বামীর অজান্তেই এটা আমি করাতে চাই।
-কিন্তু ….।
—এর মধ্যে কোন কিন্তু নেই ডাক্তার।
—আপনি অন্যত্র যেতে পারেন। কারণ আমি এসব কাজ করি না। যদিও আমি গাইনি তবুও শিক্ষার ঐ দিকটা আমি বেছে নিইনি। তার কারণ আমার ধর্ম মানুষকে পৃথিবীর আলো দেখানোর সুযোগ করে দেওয়া। তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া নয়। বিশেষ করে প্রথম অবস্থায় হলেও একটু ভেবে দেখতাম। কিন্তু এখন বাচ্চাটার পুরো বডি ফর্ম করে গেছে। এই অবস্থায় ও কাজ আমার পক্ষে অসম্ভব।
হেনা আলম দু’হাতে আমার হাত দুটি জড়িয়ে ধরলেন। ওঁর পরশে আমি দুর্বল হয়ে পড়লাম। সেটা বুঝতে পেরে আমার দুটি হাত ওঁর বুকের মধ্যে টেনে নিলেন উনি। সে কি দারুণ উন্মাদনা। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম কিন্তু কেন আপনি এ কাজ করতে চলেছেন?
—এই সন্তান আমার বাঞ্ছিত নয়।
—তাহলে আগে আসেননি কেন?
—তখন বুঝতে পারিনি সে আমাকে এইভাবে ঠকাবে বলে।
–কে সে?
—আপনি আচ্ছা লোক তো? কোন নারী কি পারে তার গোপন প্রেমিকের কথা পর পুরুষকে বলতে?
এই শীতেও আমার তখন ঘাম দেখা দিল।
হেনা আলম আমার আরো কাছে এগিয়ে এলেন। উঃ সে কি মদির উষ্ণতা। আমাকে যেন পাগল করে দিল। হেনা আলমের সুললিত করুণ কণ্ঠস্বর আবার শুনতে পেলাম—ডাক্তার!
-বলুন।
—আমার উপকার করবেন না?
–না। এ কাজ আমি করি না।
–আপনাকে আমি অনেক টাকা দেবো। আমার গায়ের সমস্ত গয়না দেবো। বিনিময়ে আপনি আমার এই উপকারটুকু করুন।
–মিসেস আলম, আপনি একটু কষ্ট করে অন্য কোথাও চলে যান। —উপায় থাকলে যেতাম।
—উপায় নেই বলেই এত রাতে লুকিয়ে এইভাবে এসেছি। সুইসাইড করলে এক্ষুনি আমার সমস্ত প্রবলেম সলভ হয়ে যায়; কিন্তু আমি বাঁচতে চাই ডাক্তার!
—আমি আপনাকে বাঁচাতে পারলাম না।
হেনা আলম উঠে দাঁড়ালেন। তারপর করুণ চোখে একবার আমার দিকে। তাকিয়ে আবার নিজেকে বোরখায় ঢেকে নিঃশব্দে চলে গেলেন।
উনি চলে যাবার অনেক পরেও আমি দরজায় খিল দিতে ভুলে গেলাম।
.
পরদিন সোনাঝরা সুন্দর সকালে গত রাত্রের ঘটনাটা ঘুমের ঘোরে একটা দুঃস্বপ্নের মতোই মনে হল আমার কাছে। আমাদের হসপিটালে এক প্রসূতি কদিন ধরেই কষ্ট পাচ্ছে। আজ একবার শেষ চেষ্টা করে দেখব স্যালাইন দিয়ে পেন আনাবার। না হলে বাধ্য হয়েই সিজার করতে হবে।
আমার কাজের লোকটি এলে তাকে রান্নার ব্যবস্থা করতে বললাম। তারপর টুক করে সামান্য কিছু বাজারও করে আনলাম। আমার এই ঘোরাফেরার মধ্যে বারবারই কিন্তু হেনা আলমের কথাটা মনে হতে লাগল। তাঁর প্রস্তাব আমার পক্ষে রক্ষা করা সম্ভব হ’ল না। তাই বলে সত্যিই কি তিনি আত্মহত্যা করবেন? যদি করেন, তাহলে কিন্তু দুটি মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী হবো আমি। অ্যাবরশনে সমস্যাটা মিটেই যায়। অথচ আমি কি করে এই কাজটা করি? একটি শিশু, প্রকৃতির নিয়মে সে আপন বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যখন পূর্ণ রূপ পেয়ে গেছে তার হাত পা চোখ মুখ সব কিছুই যখন যথাযথ নিয়মে তৈরি হয়েছে তখন তাকে তার আত্মপ্রকাশের আগেই মাতৃগর্ভ থেকে জোর করে টেনে এনে গলা টিপে মেরে ফেলাটা…। না না না এ কাজ করলে আমি পাগল হয়ে যাবো। অর্থের লালসায় এ কাজ যারা করে করুক। আমি করতে পারব না। আমার সারা শরীর যেন সেই দৃশ্য কল্পনা করে শিউরে উঠল। অসহায় শিশুর অন্তিম আর্তনাদ যেন টা ট্যা করে আমার কানের কাছে বাজতে লাগল। এ কাজ আমাকে মেরে ফেললেও হবে না। আমি অন্যমনস্ক হবার চেষ্টা করলাম।