বসার ঘরে টেলিভিশন সেটটা তখনও চলছিল। এটা বোধ হয় দাম্পত্য কলহের সাথে নবীনতম সংযোজন। টেলিভিশনের শব্দে উঁচু গলায় কথা কাটাকাটি বা দাম্পত্য কলহের বিন্দু বিসর্গও বাইরের লোক শুনতে পাবে না। টেলিভিশনের শব্দ এই কলহে এক বিশেষ আবহ সংগীতের মাত্রা যোগ করে। বিচিত্র ধ্বনি সৃষ্টি হয়। ভেতরের সব টুকু ঢাকা দিয়ে দেয়।
অনিকেত কি করবে দিশা পায় না। ভাগ্যিস টেলিভিশন সেটটা চলছিল। নইলে মেয়েটা ঘুম থেকে জেগে উঠত। বাবা মায়ের ঝগড়া দেখলে মেয়েটা অসহায়ের মতো কাঁদতে থাকে। সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে
অগ্নিসংযোগ করবে, এমন সময় বেশ জোরে একটা ভারি কিছু পতনের শব্দ হয়।
অনিকেত অতি দ্রুত ভেতরের ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।
ভেতরের ঘরে তখন গোদরেজের স্টিলাক্স আলমারিটা হাটখোলা। শাড়ি, জামা, কাপড় লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে। আলমারির ছাদ থেকে তখন আঠাশ ইঞ্চি ফাইবারের বাক্সটা মেঝের ওপর ছড়িয়ে রাখা জামা কাপড়ের উপর চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে।
অনিকেত কতকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। মুখে সিগারেট হাতে লাইটার। স্তম্ভিত দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে সে চারদিকে ঘুরে ঘুরে দেখে।
একটু আগেই বিজয়ার মুখ দিয়ে খই ফুটছিল। এখন মুখটা পাথরের মত কঠিন করে চারদিকে কী যেন খোঁজে। তারপর হঠাৎ কাপড়ের এক পাশে মাঝারী সাইজের একটা হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে বুকে চেপে ধরে মেঝেতে বসে পড়ে। তারপর বোম টিপে ঢাউস ভি. আই. পি. লাগেজটা খুলে ফেলে। বাক্সটা উলের জামাকাপড়ে ঠাসা। শরীরটাকে ঈষৎ ঝুঁকিয়ে সে উলের জামা কাপড়গুলো মেঝের ওপর ছড়িয়ে সামনে এসে পড়েছে। অবিন্যস্ত বেশবাস। চোখদুটো স্থির মুখটা কঠিন।
অনিকেত বোকার মত তাকিয়ে দেখছে। সিগারেটটা হাতের আঙুলের ফাঁকে রয়েছে। লাইটারটা অন্যহাতে ধরা রয়েছে। হঠাৎ পাশের ঘর থেকে ঘুম থেকে জেগে উঠে মেয়ে শ্রীপর্ণা এই ঘরে উপস্থিত হয়। বিজয়া তখন ফুসছে। মেয়েকে দেখেই বিজয়া হঠাৎ অগ্নিমূর্তি ধারণ করে তার দিকে তেড়ে গিয়ে বলে, এ্যাই তুই-তোর
জন্য আমি মরতেও পারছি না। তোকে আজ খুন করে….
কথাটা শেষ করার আগেই মেয়ে শ্রীপর্ণা ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে ফেলে। সে কী আকুল কান্না। মেয়ের কান্নার সাথে সুর মিলিয়ে বিজয়াও হা-হুতাশ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, বাবা গো কী পাষণ্ডর সাথে আমায় বিয়ে দিলে গো…
বিজয়ার কান্নার হিক্কা ওঠে প্রথম। এখন ও কী বলছে বোঝা যায় না। একটু আগেই অনার্স গ্রাজুয়েট, বি. এড পাশ শিক্ষিকা হওয়ার প্রবল ইচ্ছা ফুৎকারে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল।
মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বিজয়া কাঁদতে থাকে। এবার ওদের কলরোল কেবল টি.ভি’র শব্দকেও ছাপিয়ে গেছে। ঘড়ির দিকে চোখ পড়ায় অনিকেত দেখল, ঘড়িতে তখন রাত দেড়টা বেজেছে। মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে তখন মা-বিটিতে মিলে কান্নার রোল তুলেছে। বাইরে একদল কুকুর ডেকে ওঠে। অনিকেত মেয়ের মাথায় হাত রাখে। মেয়ে মাথাটা সরিয়ে নেয়। অনিকেত বোঝে মেয়ে তার দিকে আসতে ভয় পাচ্ছে। অনিকেত স্ত্রী বিজয়ার মাথায় হাত রাখে। সাথে সাথে কান্নার হিক্কা বাড়ে।
অনিকেত বলে, প্লিজ চুপ করবে। আচ্ছা বেশ সব দোষ আমার। আমি সংসার প্রতিপালনে অক্ষম এক অপদার্থ মানুষ।
কে কার কথা শোনে। কান্নার প্রবল হিক্কা এবার মেয়ে শ্রীপর্ণাকে সংক্রামিত করেছে। অনিকেত ওদের দুজনের মাঝখানে বসে দুজনকেই একসাথে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে।
বিজয়া বিজয়া কী হচ্ছে এত রাতে? বলছি তো সব দোষ আমার।—অনিকেত খানিকটা নার্ভাস হয়ে মেয়েকে বলে, মামনি তুমি কাঁদছ কেন? এই তো আমি তোমাকে আদর করছি।
মেয়ের কান্না থামে। ওর চোখের কোল দিয়ে জলের ধারা চিবুক অবদি নেমেছে। সে বাবাকে বলে, মাকেও আদর করো।
অনিকেত অসহায়ের মত বলে। সেই তো কতক্ষণ ধরে তোমাদের আদর করে চলেছি। এবার অনিকেত তার দুহাত দিয়ে বিজয়ার এলোমেলো অবিন্যস্ত চুলগুলো গুছিয়ে দেয়। বলে, বিজয়া প্লিজ একটু আমার কথা শোনো। বিজয়ার কান্নার শব্দ থামে। সে তখনও হাফাচ্ছে। চোখের জল গালে মাখামাখি হয়ে চিবুক দিয়ে বক্ষদেশের দিকে এগিয়েছে। সে যেন চোখের জলে বুক ভাসিয়ে-মনের সমস্ত অভিমান ধুইয়ে নিয়েছে।
অনিকেত বসার ঘরে এসে টি.ভি. সেটটা বন্ধ করে মেয়ে বউকে নিয়ে ডিভানের ওপর বসে। ডানদিকে বিজয়া। বাম দিকে মেয়ে শ্রীপর্ণা। অনিকেত সমান স্নেহে দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
রাত বাড়ে বিজয়া ও কন্যাকে তখন দুই কাঁধে নিয়ে অনিকেত তখন ক্লান্ত শ্রান্ত। চোখে ঘুম জড়িয়ে এসেছে।
অনিকেত দুজনকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলে। ঘুমুতে যাবে চল। রাত প্রায় ভোর হতে চলেছে।
অষুধ – শহীদ আখন্দ
কিছুদিন ধরে ঘটছিল কাণ্ডটা। রাতের খাবারটা কোনমতে গিলে কুলিটা মুখে নিয়েই সেই যে ঘর থেকে একলাফে নিচে নামে তারু মিয়া আর পাত্তা পাওয়া যায় না তারপর। ফেরে অনেক রাতে চোরের মতো। কপাটের উপরের ব্যাঙটা আর লাগায় না। সুরুয বানু, মানুষটা বাইরে আছে যখন কি জানি কত রাত হয় ফিরতে, নিচের ব্যাংটা বরং বাইরে থেকে খোলা যায়। চোরের মত কখন ফেরে রাতে, সুরুয বানু টের পায় মাঝে-মাঝে, টের পায়না কোনদিন। প্রথম দিকে পাত্তা দেয়নি সুরুয বানু, সারাদিন খাটে বন্ধে বাইরে, সন্ধ্যেবেলায় কোথাও একটু গিয়ে তামাক টানল, গপ্পো-টপ্লো মারল তাতে গা চুলকানোর কি আছে! কিন্তু আস্তে আস্তে ঘটনাটা কেমন চোখে ঠেকছে। মনে ঠেকছে। সন্ধ্যা থেকে এত রাত পর্যন্ত কোথায় কোন রসের এমন ভাণ্ডার আছে যে, খালি বিছানায় তাকে এমন খালি গড়াগড়ি খেতে হবে আর বার বার দরজার দিকে কোন পরিচিত শব্দের জন্য কান পেতে পেতে কাহিল হয়ে পড়ে ঘুমাতে হবে? সে জায়গাটা কোথায়? সুরুয বানু একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, খায়া কুলিটা ফালানির তর সয়না কই যাওয়ার জন্য এমুন পাগল হন, রুজ রুজ রাইতের বেলা?