অনেক কান্না, অনেক হেঁচকি। কতবার নাক মোছার পর শ্রাবণী দেখলেন, ড্রেসিং টেবিলটার একেবারে যা তা অবস্থা। এখানে ওখানে ছেঁড়া কাটা চুল। আবছা ঝুল। সারা ড্রেসিং টেবিলটা জুড়ে একটা নোংরা আস্তরণ। একবার ভাবলেন, পরিষ্কার করবেন। কিন্তু না, থাক। কি হবে? ভাবতে ভাবতে কি যেন চোখে পড়ল।ওগুলো কি? কাছে গিয়ে হাতে তুলে নিলেন। গোল গোল করে কাটা দু’টুকরো শশা। আধপচা, প্রায় শুকনো শশার টুকরো দুটো আরও গোস্লা পাকিয়ে গেছে। ঠিক যেন দুটো পচা চোখ।
অনের রাতের অনেক কান্নার শেষে, হাতের তেলোয় ধরা গোল্লা পাকানো শশা দেখতে দেখতে শ্রাবণী ফিসফিস করে নিজেকে বললেন,—এমন পচা চোখ নিয়ে সতীন খুঁজে বেড়াব? মা গো!
রাত বয়েই যাচ্ছিল।
অনিকেত – সঞ্জয় ব্রহ্ম
রাতের খাওয়া সেরে অনিকেত বসার ঘরে বসে টেলিভিশন দেখছিল। স্ত্রী বিজয়ার তখন সংসারের কাজ গুছিয়ে রাতে শোবার সময়। পাঁচ বছরের মেয়ে শ্রীপর্ণা ঘুমিয়ে পড়েছে।
টেলিভিশনে কোন একটা চ্যানেলে তখন অর্থনৈতিক বিষয়ের ওপর বিতর্কে অংশ গ্রহণ করেছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদগ্ধ পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ। অনিকেত খুব মনোযোগ দিয়ে এদের আলোচনা শুনছে। স্ত্রী বিজয়া এসে পাশের সোফায় বসল। তার মুখটা কঠিন। চোখে মুখে বিরক্তি ভাব। কপাল কুঁচকে রয়েছে। সে হঠাৎ বলে ওঠে,—তোমার বাবা একটা অর্থপিচাশ। তুমি একটা অপদার্থ, তাই তোমার নাকের ডগা দিয়ে তোমাকে কাঁচকলা দেখিয়ে সম্পত্তি ভাগ হয়ে গেল।
অনিকেত টেলিভিশনের ঐ অনুষ্ঠানটি মন দিয়ে শুনছিল। সে বিজয়ার ঐ আকস্মিক বাক্যবাণে প্রায় কার কণ্ঠে বলে, কেন আমার জন্য তিনতলার ছাদের ঘরটা তো আছেই। বাবার অবর্তমানে ঐ ঘরটা তো আমার। প্লাস ক্যাশ।
বিজয়া মুখ ভেঙ্গিয়ে হাত নেড়ে অঙ্গভঙ্গি করে বলে, নিচ তলার ঘর…ক্যাশ!–বাবার অবর্তমানে তুমি কচু পাবে।
অনিকেত একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, আচ্ছা তুমি হঠাৎ আমার পৈত্রিক সম্পত্তি নিয়ে পড়লে কেন? সে প্রসঙ্গ তো আমিও তুলতে পারি। আইন অনুযায়ী পৈত্রিক সম্পত্তিতে তোমারও সমান অধিকার রয়েছে।
তুমি তো খুব লোভী দেখছি। পরের সম্পত্তিতে লোভ।
বাবা কি তোমার পর নাকি?
দেখ ফালতু কথা বলবে না। আমি কেন বাবার বাড়িতে ভাগ বসাতে যাবো। বাবা আমাকে খরচা করে বিয়ে দিয়েছেন।
অনিকেত দৃষ্টি টেলিভিশনের দিক থেকে সরে এসেছে। সে এবার বিজয়ার মুখোমুখি হয়ে কুঁচকে বলে, খরচা করে? তুমি তোমার বাবার হয়ে ওকালতি করছ। কর। কিন্তু তোমার বাবাও কম ধুরন্ধর না। আমাদের পক্ষ থেকে দাবীহীন বলায় ওনার তো পোয়াবারো হয়েছিল। ঐ যা দিয়েছেন সব তোমাকে। তোমার গয়নাগাটি। আর আত্মীয় ডেকে খাওয়ানো। তাও-তো সে খাবার খেয়ে আমার দুই অফিস কলিগ। অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। কাজেই তোমার বাবা একটা পয়লা নম্বরের…কথাটা শেষ করে অনিকেত।
বিজয়া চেঁচিয়ে ওঠে। তুমি আমার বাবাকে গালি দেবে না। খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি। তোমার কোন ধারণা নেই—একটা মেয়ে বিয়ে দিতে কত খরচ। নিজের একটা মেয়ে হয়েছে তো; বুঝবে তাকে পার করতে কত খরচ। তখন মুরোদ কত দেখব।
বিজয়ার দিকে আঙুল তুলে অনিকেত বলে তুমি কিন্তু প্রসঙ্গ ছেড়ে এখন উল্টোপাল্টা বলছ, চুপ করবে?
ইস্ আমি উল্টোপাল্টা বলছি। আর তুমি যা বল ঠিক বল? মাসের আজ কুড়ি তারিখও হয়নি। এখনই তোমার পকেট গড়ের মাঠ। টাকা চাইলে পাওয়া যায় না।
মাসের শেষে পকেটের দুরুবস্থা সব চাকরীজীবির-ই হয়।
সবার হয় না। হয় তোমার মত পাঁচু কেরাণীর। এ কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছ কেন?
এবার অনিকেতের আত্মসম্মানে আঘাত লাগে। সে বলে, জেনে শুনে তোমার বাবা কেরাণীর সাথে বিয়ে দিলেন কেন?—ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, টাকাওয়ালা ব্যবসাদার খুঁজলেই পারতেন।
সেটা তোমার বাবার আদিখ্যেতা। আমাকে দেখার পর থেকেই এ মেয়ে সুলক্ষণা, এর সাথেই ছেলের বিয়ে দেব। আর বিয়েটা তাড়াতাড়ি দেবার জন্য কত মিষ্টি মিষ্টি কথা। নইলে কত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার আমাকে প্রপোজ করেছিল।
বেশ তো তাদের কাঁধে ঝুলে পড়লেই পারতে।
অনিকেতের এই কথা শুনে, বিজয়া এবার তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। ঝুলে পড়া মানে কি বোঝাতে চাইছো? তার মানে আমি তোমার বোঝা?
আহ্ বোঝা হতে যাবে কেন? আমার রোজগারের ওপর নির্ভরশীল।
সে-তো তোমার জন্য। বিয়ের পরই বাচ্চা হল। বাচ্চা মানুষ করতে করতে এপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের কার্ডটা ল্যান্স হয়ে গেল।
ইস্ কার্ড থাকলেই যেন চাকরী হেঁটে হেঁটে বাড়িতে হাজির হোত।
হ্যাঁঁ হত। স্কুল মাস্টারী অবশ্যই হত। আর শিক্ষকতা করব বলেই অনার্স পাশ করে বি.এড পাশ করেছিলাম।
রাখ রাখ তোমার মত বাংলায় অনার্স বি.এড রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে।
কি বললে, রাস্তায় গড়াগড়ি। তার মানে আমি একটা রাস্তার মেয়ে। কথাটা বলে বিজয়া ঘ্যান ঘ্যান করে ওঠে।
হরিবল্। তুমি দেখছি পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করছ।
কী বললে, হরিবল তুমি আমাকে মরতে বলছ?
কী অসহ্য।
আমাকে অসহ্য লাগছে। কথাটা শেষ করেই বিজয়া হঠাৎ যেন আগুনের মতো ফুঁসে ওঠে।
আমি এক্ষুনি এখান থেকে বেরিয়ে যাবো।–রইল তোমার মেয়ে।
কথা লতার মতো লতিয়ে লতিয়ে ধোয়ার কুণ্ডলী হয়ে শেষ পর্যন্ত চারদিক ঝাঁপসা করে দেয়। বিজয়া এখন কথা থামিয়ে ছুটে যায় ভেতরের ঘরের দিকে।