- বইয়ের নামঃ দুই বাংলার দাম্পত্য কলহের শত কাহিনী
- লেখকের নামঃ ইমদাদুল হক মিলন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ সাহিত্যম
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
অঙ্কুর – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
রাত তখন কত তা বলতে পারব না। কেননা আমি ঘড়ির দিকে তাকাই নি। হঠাৎ কলিংবেলটা বেজে উঠতেই ঘুম ভেঙে গেল। জিরো পাওয়ারের আলোটা জ্বলছিল তাই সুখশয্যা ছেড়ে টিউব লাইটের সুইচটা অন করলাম। আলো জ্বলে উঠতেই কলিংবেল থেমে গেল।
দরজা খোলার আগে সাড়া দিলাম—কে?
বাইরে টক টক শব্দ।
আবার বললাম—কে?
—একবার দরজাটা খুলুন না?
নারীর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। এই প্রচণ্ড শীতের রাতে কেরে বাবা! বললামকাকে চাই?
—আমি ডাক্তার সেনকে চাইছি। বিশেষ দরকার।
নিশ্চয়ই কোন ডেলিভারি কেস। গাইনি হওয়ার বড় জ্বালা। অথচ উপায় নেই। প্রসূতি এবং নবজাতকেরা জীবন মরণ সমস্যা হলে যেতেই হবে। এই মফঃস্বল শহরে। আমি আসবার পর থেকে ঠাকুরের কৃপায় একবারও ব্যর্থ হইনি। আমার হাতে যেসব শিশু জন্মগ্রহণ করেছে তারা সবাই সুস্থ। কাজেই এই অঞ্চলে ডাক্তার হিসেবে আমার যথেষ্ট সুনাম হয়েছে।
আমি চোর ডাকাত বা দুষ্ট লোকের ভয় করি না। তার কারণ এখানকার মানুষজন খুব ভালো। এরা আর যাই করুন না কেন আমার কোন ক্ষতি করবে না। করলে এরাই বিপদে পড়বে। আমি গভীর রাতে এলাকা থেকে বহুদূরে ভাঙা বাড়ির এক কোণে পড়ে থাকা যন্ত্রণাকার ভিখারিনীকেও বিনা পারিশ্রমিকে সন্তান প্রসব করিয়ে এসেছি। আবার অনেক প্রাসাদোপম অট্টালিকার ভেতরেও বৃষ্টি বাদল মাথায় নিয়ে হাজির হয়েছি মধ্যরাতে।
আবার টক টক শব্দ—দরজাটা খুলুন। আমি নির্ভয়ে দরজা খুললাম।
দরজার সামনে বোরখা ঢাকা এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রচণ্ড শীতে শির শির করে কাঁপছেন তিনি।
–বলুন।
-আপনিই কি ডাঃ সেন? আমি একটা ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
—ভেতরে আসুন।
মহিলা ভেতরে এলে দরজা বন্ধ করলাম। যদিও এটা আমার নীতিবিরুদ্ধ ও করলাম রাত গভীর এবং শীতের দাপট বেশি বলে। সারা গায়ে শালটা মুড়ি দিয়ে আরামকেদারায় বসে মহিলাকে বসতে বললাম।
মহিলা বসতে বসতে বললেন—এমন অসময়ে আপনাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে সত্যিই খুব অন্যায় করেছি। অথচ বিশ্বাস করুন এ ছাড়া কোন উপায় ছিল না।
আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না ব্যাপারটা কি। কে এই রহস্যময়ী? এত রাতে আমাকেই বা তার কিসের প্রয়োজন? তবে এই মুহূর্তে আমাকে যে শীতের কামড় খেয়ে বাইরে বেরতে হবে না তা বেশ বুঝতে পারলাম।
শুধু বুঝতে পারলাম না এই বোরখার আড়ালে যিনি লুকিয়ে আছেন তিনি কি রকম। কুমারী না সধবা? যুবতী না বিগতযৌবনা? তবে তার শ্বেত-শুভ্র দুটি হাত ও পায়ের পাতা দেখে বুঝলাম যে বোরখার আড়ালে এক বিদ্যুত্বর্ণা লুকিয়ে আছেন।
তিনি কিছু বলছেন না দেখে আমিই বললামবলুন, এত রাতে আপনি আমার কাছে কেন এসেছেন?
মহিলা কি যেন বলতে চাইলেন অথচ বলতে পারলেন না। তাঁর গলাটা একবার একটু কেঁপে উঠল শুধু।
আমি বললাম-এই প্রচণ্ড শীতে এত রাতে এসেছেন, আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই? একটু কফি খাবেন?
সুরেলা গলার মহিলা বললেন—পেলে ভালো হয়। আমি উঠে গিয়ে হিটারে জল গরম করতে দিলাম।
—আপনি একা থাকেন বুঝি।
-হ্যাঁ। তবে আমার একজন লোক আছে। বেচারি বুড়ো মানুষ। পাশের বাড়িতে থাকে। একটু কফির জন্য তাকে আর ডাকলাম না।
–এ ব্যাপারে আমি কি আপনাকে একটু সাহায্য করতে পারি? অবশ্য যদি আপনার সংস্কারে না বাধে।
–না না, ও কিছু নয়। আমার কোন সংস্কার নেই। তবে আপনি আমার অতিথি। আর এই কাজে আমি অভ্যস্থ। তাই–।
—আপনার বউ নেই?
—আমি এখনো বিয়ে করিনি।
কথা বলতে বলতেই কফি তৈরি করলাম। এক কাপ নিজে নিয়ে এক কাপ এগিয়ে দিলাম তার দিকে। রহস্যময়ী নারী কফির পেয়ালাটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর আমার দিক থেকে একটু সরে গিয়ে আমার দিকে পিছন হয়ে ঘরের চারিদিক দেখতে দেখতে কফি খেলেন।
এই সময় আমার খুব ভয় হল। কে ইনি? এমন স্পর্ধা কি করে হল? রাত দুপুরে ঘরে ঢুকে ঘরের চারিদিক এইভাবে দেখার মানে কি?
আমি একটু গম্ভীর হয়ে বললাম— শুনুন, আপনি কি বলতে চান তা চটপট বলে ফেলুন। এখন অনেক রাত। আমার চোখে ঘুম আছে তার ওপর এই শীতে আমি আপনাকে বেশিক্ষণ সময় দিতে পারব না।
মহিলা মৃদু হেসে আমার সামনে টি-পটে কফির শূন্য পেয়ালাটা নামিয়ে রেখে বললেন—খুব ভয় পেয়ে গেছেন, না? ভাবছেন নিশ্চয়ই কোন জিন কবরখানা থেকে উঠে এসেছে। অথবা বোরখার আড়ালে লুকিয়ে আছে কোন ফুলন দেবী।
আমার মনের ভাব ঠিক বুঝতে পেরেছেন তো? আশ্চর্য। অসাধারণ বুদ্ধিমতী মহিলা। বললামনা, মানে সারাদিন রোগিনীদের সংস্পর্শে থাকার ফলে আমি খুব ক্লান্ত। আবার সকাল থেকেই শুরু হরে পরিশ্রম। তাছাড়া এক্ষুণি এই মুহূর্তেই হয়তো কোন মরণাপন্ন প্রসূতির জীবন রক্ষার জন্য ছুটতে হবে, কিংবা কোন নবজাতককে দেখাতে হবে পৃথিবীর আলো। কাজেই আমারও তো বিশ্রামের প্রয়োজন।
রহস্যময়ী এবার আমার মুখোমুখি বসলেন। তারপর বললেন—আমি অত্যন্ত বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি। আপনি যদি আমার একটু উপকার করেন তাহলে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। নাহলে হয়তো আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে।
—সেকি।