আমি খুব ভয়ে ভয়ে স্যারকে বললাম, স্যার আপনি যে বইয়ে লিখেছেন ‘কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জগৎ অবজারভার নির্ভর। যেহেতু আমরা প্রতিটি ইলেকট্রন অবজারভ করছি না সেহেতু এই জগৎ অস্পষ্ট এবং সম্পূর্ণই ধোঁয়াটে!’
স্যার সামান্য বিস্মিত হয়ে বললেন, তা অবশ্যি বলেছি। তার বিস্ময়ের কারণটা স্পষ্ট। তিনি আশা করেননি একজন প্রুফ রিডার তার লেখা বইয়ের অংশ মুখস্থ বলবে।
আমি বললাম, স্যার একজন observer তো আছে যে observer প্রতিটি ইলেকট্রন প্রোটন দেখছে। কাজেই সেই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জগৎও নির্দিষ্ট। অস্পষ্ট না।
স্যার বললেন, সেই অবজারভারটা কে?
আমি বললাম, স্যার আল্লাহপাক।
তোমার পড়াশোনা কী?
আমি বললাম, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হব বলে এসেছি। কেমিস্ট্রি পড়ার ইচ্ছা।
রেজাল্ট কী?
আমি রেজাল্ট বললাম।
স্যার বললেন, কেমিস্ট্রি ছাতামাতা পড়ে লাভ নেই। মূল বিজ্ঞান হলো পদার্থবিদ্যা। সৃষ্টির রহস্য জানতে হলে পদার্থবিদ্যা পড়তে হবে। তুমি পড়বে ফিজিক্স।
আমি তখন সামান্য সাহস পেয়েছি। আমি বললাম, সৃষ্টির রহস্য তো স্যার কোনো দিনই জানা যাবে না।
কেন জানা যাবে না?
আমি বললাম, স্যার আমরা তো সৃষ্টির একটা অংশ। সৃষ্টির অংশ হয়ে সৃষ্টিকে কীভাবে জানব? সৃষ্টিকে জানতে হলে তার বাইরে যেতে হবে। সেটা কি স্যার সম্ভব?
না, সম্ভব না।
আমি বললাম Big Bang থেকে সৃষ্টি শুরু। সৃষ্টিকে জানতে হলে আমাদের Big Bang-এর আগে যেতে হবে। স্যার, এটা কি সম্ভব?
স্যার বললেন, বিজ্ঞান নিয়ে তুমি কি পড়াশোনা করো।
হাতের কাছে বইপত্র যা পেয়েছি পড়েছি। সবই Popular Science.
যেসব বই পড়েছ তার একটা নাম বলো।
আমি বললাম, The hole in the universe. অথরের নাম K. C. Cole.
আমার কাছে প্রচুর বই আছে। Popular Science না Real Science. তুমি যেকোনো বই আমার লাইব্রেরি থেকে নিতে পারো। খাতায় নাম লিখে বই নেবে। যখন ফেরত দেবে নাম কেটে দেবে।
জি স্যার।
আজ থেকেই শুরু হোক। নিয়ে যাও কিছু বই।
স্যারের বাসা থেকে চারটা বই নিয়ে এলাম। এর মধ্যে একটা উপন্যাস।
উপন্যাসের নাম The curious incident of the dog in the night time.
বইটার লেখকের নাম Mark Haddon.
.
স্যার, এখন আমি মূল গল্পে ঢুকব।
আমার বস মোবারক উদ্দিন সাহেব আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। থাকার ব্যবস্থা হলো তার গুদাম ঘরে। পুরনো ঢাকায় যেমন বহুদিনের পুরনো দালানকোঠা থাকে সেরকমই একটা দালান। মিউনিসিপ্যালিটি পাঁচ বছর আগে বিল্ডিংটাকে Condermed ঘোষণা করে ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে। আমার বস টাকা খাইয়ে সেটা বন্ধ রেখেছেন। বাড়িটার নাম ‘আশা কুটির’। বাড়ির শ্বেতপাথরের মেঝে থেকে বোঝা যায় একসময় এর অনেক শান-শওকত ছিল। তখন পুরোদস্তুর জঙ্গলখানা। একতলায় প্রেসের ম্যাটার, পুরনো বইয়ের গাদা একটা ভাঙা ট্রেডল মেশিন। সিসার টাইপ। দুই সেট উইয়ে খাওয়া সোফা। দোতলার চারটা ঘরের দু’টার দরজা-জানালা কিছুই নেই। একটা অংশের দেয়াল ভেঙে পড়েছে। দুটো অক্ষত ঘরের পুরোটা পুরনো আমলের ফার্নিচারে ঠাসা। বড় একটা আলমারি আছে। সেই আলমারি তালাবদ্ধ! তালায় জং পড়েছে। গত দশ বছরে এই আলমারি কেউ খুলেনি তা বোঝা যাচ্ছে। আমাকে ঘর দু’টার যেকোনো একটায় থাকতে বলা হলো। আমার প্রতি দয়া দেখিয়ে যে কাজটা করা হলো তা-না। পাহারাদারের কাজ পেলাম। একজন দারোয়ান সারা রাত বাইরে ডিউটি দেবে। আমি থাকব ভেতরে। ডবল সুরক্ষা।
ফার্নিচার সরিয়ে একটা ঘরের কোণায় চৌকি পাতলাম। ঘরটায় জানালা নেই। তিনটা জানালাই পেরেক মেরে পুরোপুরি বন্ধ। দরজা খোলা রাখলে সামান্য আলো আসে। দরজা বন্ধ করলেই কবরের অন্ধকার।
দারোয়ানের সঙ্গে আলাপ করলাম। একটা জানালা খোলা যায় কি-না। দারোয়ান বলল, কেন যাবে না! বসকে বলে মিস্ত্রি ডাকিয়ে খুলে দিলেই হয়।
বস কি রাজি হবেন?
অবশ্যই রাজি হবেন। ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ডাকতে হবে। দোতলায় ইলেকট্রিকের তার ছিঁড়ে গেছে। তার ঠিক করতে হবে। একটা ফ্যান লাগবে। ফ্যান ছাড়া ঘুমাতে পারবেন না।
আমি বললাম, ফ্যান পাব কই?
দারোয়ান বলল, ফ্যানের অসুবিধা নাই। একতলায় মালখানায় কয়েকটা ফ্যান আছে।
দারোয়ানের নাম ছামছু। আমি তাকে ডাকি সামসু, বয়স চল্লিশের মতো। তার তিনটা রিকশা আছে, ভাড়ায় খাটে। রাত বারোটায় রিকশাওয়ালা রিকশা জমা দিয়ে যায়। তখন সামসু গুদামঘর পাহারা বাদ দিয়ে নিজেই রিকশা নিয়ে বের হয়। রাত বারোটার পর রিকশা ভাড়া হয় দু’গুণ তিনগুণ। অল্প পরিশ্রমে ভালো পয়সা।
সামসু বলল, আপনি বসকে আমার রিকশা নিয়ে ট্রিপে যাওয়ার কথা বলবেন না। আমিও আপনার বিষয় কিছু বলব না।
আমি বললাম, আমার কী বিষয়?
সামসু নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, আপনি যুবক ছেলে। যুবক ছেলের কত বিষয়ই থাকতে পারে। ধরেন ঘরে মেয়ে মানুষ নিয়া আসলেন।
প্রথম বারের মতো রাতে গুদামঘরে থাকতে গেলাম। মিস্ত্রি ডাকা হয়নি। ইলেকট্রিসিটির কানেকশন নাই। হারিকেন জ্বালিয়েছি। দরজা বন্ধ করতেই ভাদ্রমাসের তালপাকা গরমে তুঙ্গে গেলাম। বড় ভুল যেটা করেছি তালপাতার হাতপাখা কেনা হয়নি। খাবার পানির ব্যবস্থা করেছি। এক জগ পানি রেখেছি টেবিলের ওপর। টেবিলটা সাধারণ না। ময়ুর আঁকা আধা পুরনো আমলের গাবদা ড্রেসিং টেবিল। বড় আয়না আছে। আয়নার মাঝামাঝি বড় ধরনের ভাঙা হারিকেনটাও ঐ টেবিলে রাখা। হারিকেনের আলোয় বই পড়ে রাত কাটানো ছাড়া অন্য উপায় নেই। মূল দরজাটা খোলা রাখলে কিছু আলো আসত। কিন্তু বস বলে দিয়েছেন-ডাবল সিটকিনি দিয়ে দরজা লাগাতে। ঘরে অনেক দামি দামি পুরনো আমলের জিনিস আছে।